জ্বালানি তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশে এক ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এটা স্বাভাবিক। ইতোপূর্বে যখনই তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, তখনই একই অবস্থা আমরা লক্ষ্য করেছি। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি সব সময় একটি অজনপ্রিয় কাজ। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে হয়। এরপরও বিরূপ পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য বাস্তবতার নিরীখে এ ধরনের দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনও বিকল্প থাকে না। আমরা ইতোপূর্বেও দেখেছি বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম ওঠা-নামা করতে। সকলের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস করা হয়েছিল। আবার ২০২১ সালে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে তা পুনরায় বৃদ্ধি করতে হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস কোনও সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না, সবটাই আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু গতকাল রাতে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি নিয়ে অনেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ও জ্বালানির তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। উন্নত রাষ্ট্রসমূহও এই পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া গোটা পৃথিবীর জ্বালানি বাজারের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। এই নিদারুণ বাস্তবতায় আইএমএফ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশসহ প্রায় ৯৩টি রাষ্ট্র আইএমএফ-এর কাছে আর্থিক ঋণের জন্য আবেদন করেছে। রাশিয়া পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের জ্বালানি তেল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বলা যায়, এই চলমান যুদ্ধে জ্বালানিকে একটি ‘weapon of war’ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যার কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের অভূতপূর্ব কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানব সভ্যতা এমন সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ এবং অর্থ দিয়েও ধনী ও উন্নত রাষ্ট্রসমূহ গ্যাস মজুদ করতে পারছে না। ইউরোপের গ্যাস ব্যবহারের শতকরা ৪০ ভাগ রাশিয়া থেকে সরবরাহ করা হতো। গ্যাস সংকটের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাও উল্লেখযোগ্যভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বের এই সংকটময় পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশকেও পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো মূল্য সমন্বয় করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এই সমন্বয়েরই একটি অংশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় বার সরকার পরিচালনার সুযোগ পাওয়ায় বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়েছেন। যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই দেশের আর্থিক উন্নয়নের সূচকের ঊর্ধ্বগতি অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। যেমন, মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধিতে আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারতকে পেছনে ফেলেছি। রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণেই করোনা মহামারির সময়ে আমরা বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রণোদনা দিয়ে বৈশ্বিক সংকটময় মুহূর্তেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়েছে। দেশের প্রতিটি সেবা খাতেই– বিশেষত কৃষিখাত ও জ্বালানি খাতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। যাতে করে বিশ্ববাজারে মূল্য বৃদ্ধির চাপ জনগণকে সম্পূর্ণভাবে স্পর্শ না করে। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মোট ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা (যা জিডিপির ১.৭০%) ভর্তুকি দিয়েছে। তারপরও জনগণ ও দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কাঠামো বিবেচনায় রেখে বৈশ্বিক বাস্তবতা ও পরিস্থিতির কারণেই অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।
ইউরোপের যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-এর প্রতিদিনের লোকসানের পরিমাণ ছিল প্রায় শতাধিক কোটি টাকা। গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিপিসি প্রায় ৮,০১৪ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনও রাষ্ট্র এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি তেল বিক্রি করে নাই। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে যখন (১২ জুলাই ২০২২) লিটার প্রতি ডিজেলের মূল্য ছিল ৯২.৭৬ রুপি (১ রুপি সমান ১.২৩ টাকা হিসেবে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১৪.০৯ টাকা) তখন বাংলাদেশে প্রতি লিটার ডিজেল প্রায় ৩৪.০৯ টাকা কমে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে যখন পেট্রোল ১০৬.০৩ রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩০.৪২ টাকা) বিক্রি হয়েছে তখন বাংলাদেশে পেট্রোলের মূল্য ছিল তাদের থেকে ৪৪.৪২ টাকা কম, অর্থাৎ ৮৬ টাকা। উল্লেখ্য, শুধু ভারতই নয়, এই সময়ে চীন, আরব আমিরাত, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকংসহ অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের দাম আমাদের থেকে অনেক বেশি ছিল।
বিশ্ববাজারে ব্যারেল প্রতি ডিজেলের দাম ৭৪.০৪ মার্কিন ডলার এবং অকটেন প্রতি ব্যারেল ৮৪.৮৪ মার্কিন ডলারে থাকলেই কেবল ডিজেল ও অকটেন প্রতি লিটার বাংলাদেশে যথাক্রমে ৮০ ও ৮৯ টাকা বা বিদ্যমান মূল্যে বিক্রয় সম্ভব হতো। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আন্তর্জাাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ডিজেল প্রথমে ব্যারেল প্রতি ১০৮.৫৫ মার্কিন ডলার এবং ক্রমাগতভাবে তা বেড়ে জুলাই-২০২২ দাঁড়িয়েছে ব্যারেল প্রতি ১৩৯.৪৩ মার্কিন ডলার। একইভাবে অকটেনের মূল্যও গত ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যারেল প্রতি বেড়ে দাঁড়ায় ১০৮.০৪ মার্কিন ডলার এবং ক্রমাগতভাবে তা বৃদ্ধি পেয়ে জুলাই ২০২২-এ দাঁড়িয়েছে ১১৪.৯৬ মার্কিন ডলার।
বর্তমানে বিশ্বের ২য় সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩৫ টাকা। যা গত মে মাসে ছিল ৫৫ টাকা। ফ্রান্সে প্রতি লিটার অকটেন বাংলাদেশি মুদ্রায় ২২০ টাকা, পেট্রোল ২৩২ টাকা ও ডিজেল ২২৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আয়ারল্যান্ডে ২ মাস আগে যেখানে পেট্রোল ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩০ টাকা তা এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা। দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি মুদ্রা ১৪৪ টাকা। অস্ট্রেলিয়ায় দফায় দফায় বাড়ছে তেলের দাম, সেখানে প্রতি লিটার পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫০ টাকা আর ডিজেল ১৬০ টাকায়। জার্মানিতে ডিজেলের বর্তমান দাম লিটার প্রতি ১৮৯ টাকা ও পেট্রোল ১৭৫ টাকা। মালদ্বীপে পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি ১০২.৬১ টাকা ও ডিজেল ১০৩.৯৮ টাকা। নেপালে লিটার প্রতি পেট্রোলের দাম ১৩৫.৩৬ টাকা, ডিজেল ১২৮.৬৩ টাকা এবং কেরোসিন ১২৮.৬৩ টাকা। ভোক্তা পর্যায়ে ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত দেশে ৫০% থেকে ৫৫% পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সাল থেকে গত ৬ বছরে পেট্রোল ও অকটেনের মূল্য এক টাকাও বৃদ্ধি করেনি।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির এই প্রেক্ষাপটে সর্বশেষ জুলাই মাসে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১০,৩১২.৭৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্য আরও বৃদ্ধিও পেয়েছে। এমন বৈশ্বিক সংকট উত্তরণে পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো আমাদের দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না।
এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে বাজারের অন্যান্য খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। মানুষের কষ্ট হতে পারে। তা জেনেও দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো বিশেষত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সার্বিক বিবেচনায় মূল্য বৃদ্ধির বিকল্প অন্য কোনও পথ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের বাজার হ্রাস পেলে এবং মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল হলে সরকার অবশ্যই সাথে সাথে জ্বালানি তেলের মূল্য পুনরায় সমন্বয় করবে। বাংলাদেশে তেলের সরবরাহের কোনও প্রকার ঘাটতি নেই। এই নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে যাতে কোনও প্রকার ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি না হয় তাই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
কেউ কেউ বলছেন পেট্রোল এবং অকটেন দেশে উৎপাদিত হলে তার দাম বাড়ার কারণ কী? হ্যাঁ, বাংলাদেশ চাহিদার শতভাগ পেট্রোল এবং অধিকাংশ অকটেন উৎপাদন করে। তবে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এছাড়াও প্রতিবেশি দেশ ভারতে লিটার প্রতি পেট্রোল ও অকটেনের দাম বাংলাদেশের বিদ্যমান মূল্য থেকে অনেক বেশি ছিল। এ পার্থক্যের কারণে পাচাররোধ বিবেচনায় এবং আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে, পরিস্থিতি এমনই যে পৃথিবীর ধনী রাষ্ট্রসমূহও জ্বালানি তেলের মূল্য ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি করতে বাধ্য হচ্ছে। তাই বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের সকলকে জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে এবং ধৈর্য্যরে সাথে বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবিলায় সকলকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলো জ্বালানি সংযম (energy restraint) মেনে চলার জন্য সেদেশের নাগরিকদের অনুরোধ জানিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো শতকরা ১৫ ভাগ গ্যাস ব্যবহার হ্রাস করেছে। এমনকি এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিডিপি ১.৫% কমে গেছে। কেউ গুজবে কান দেবেন না, অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না।
সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রাখুন। অতীতের ন্যায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সকল সংকট মোকাবিলা করে বাঙালি জাতি যেভাবে আমাদের জাতিগত অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে, ঠিক তেমনই বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বেই আমরা এই সংকট মোকাবিলা করতেও সক্ষম হবো। পরম করুণাময় আমাদের সহায় হোন।
লেখক: ব্যারিস্টার; দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।