মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের পর তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। সোমবার বিকালে নয়াদিল্লির আর্মি রিসার্চ অ্যান্ড রেফারাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে এক টুইট বার্তায় প্রণব মুখার্জির ছেলে অভিজিৎ মুখার্জি জানান, ‘দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, সেনা হাসপাতালের চিকিৎসকদের আপ্রাণ প্রচেষ্টা, সারা ভারতের মানুষের প্রার্থনা, দুয়া সত্ত্বেও এইমাত্র আমার বাবা শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় মারা গিয়েছেন। আমি আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
এর আগে ৯ আগস্ট রাতে বাড়িতে বাথরুমে পড়ে মাথায় ও হাতে চোট পান প্রণব মুখার্জি। পরেরদিন সকালে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে পরীক্ষার পর জানা যায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং কিছু সেলও ড্যামেজ হয়েছে। অন্য সব পরীক্ষার সঙ্গেই নিয়ম মেনে করোনা পরীক্ষা করলে তার কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে। পরে সোমবার রাত আটটা নাগাদ পরিবারের অনুমতি নিয়ে চিকিৎসকেরা প্রণবের অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন। এরপর তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়।
প্রণব মুখার্জি ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে বিভিন্ন সময়ে তিনি দেশটির অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের বীরভূম জেলার মিরাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের সদস্য হন তিনি। শিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক হন তিনি। এর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইন পাশ করেন।
কর্মজীবনের শুরুতে কলকাতায় ডাক বিভাগের কারণিক পদে যোগ দেন তিনি। ১৯৬৩ সালে বিদ্যাসাগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ‘দেশের ডাক’ নামে একটি সংবাদপত্রে কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছিলেন তিনি।
১৯৬৯ সালে মেদিনীপুর উপ-নির্বাচনে তার রণনীতিতে জয়লাভ করেন নির্দল প্রার্থী। এতেই ইন্দিরা গান্ধীর নজরে পড়েন তিনি। প্রণব মুখার্জিকে দলে যোগদান করান ইন্দিরা। সেই বছরই রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। এর পরও ৪ বার রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন তিনি।
১৯৭৩ সালে মন্ত্রিসভায় জায়গা পান তিনি। তাকে শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮২ সালে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরলে অর্থমন্ত্রী হন প্রণববাবু। ১৯৮০ সালে রাজ্যসভায় কংগ্রেসের দলনেতা হন তিনি।
ইন্দিরাগান্ধীর হত্যার পর রাজীবের সঙ্গে মতানৈক্যের পর তাল কাটে। কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয় প্রণবকে। সেই সময় রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে একটি দল গঠন করেন তিনি। তবে তা তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি। ১৯৮৯ সালে ফের কংগ্রেসে যোগ দেন তিনি। কংগ্রেসের সঙ্গে বিলয় ঘটান তার দলের।
১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর হত্যার পর কংগ্রেসে ফের সক্রিয় হন প্রণব। তাকে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও। পরে তার মন্ত্রিসভায় যোগ দেন প্রণব মুখার্জি। নরসিংহ রায়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান তিনি।
১৯৮৫ সালে প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হন তিনি। ২০০০ সালে তাকে ফের এই পদ গ্রহণ করতে হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন তিনি।
২০০৪ সালে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর আসন থেকে জিতে প্রথমবার লোকসভায় যান প্রণব মুখোপাধ্যায়। কংগ্রেসের লোকসভার নেতা নির্বাচিত হন তিনি।
মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভায় অর্থ, প্রতিরক্ষা ও বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২০১২ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর ঘোষণা করেন প্রণব। এর পর কংগ্রেসের তরফে রাষ্ট্রপতি হিসাবে তার নাম প্রস্তাব করা হয়। ২০১২ সালের ২৫ জুলাই প্রথম বাঙালি হিসাবে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৯ সালে তাকে ভারতরত্নে ভূষিত করে কেন্দ্রীয় সরকার।