চলতি বছরের ১৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে একটি প্রাইভেটকারের পাঁচ আরোহী নিহত হন। ক্রেন দিয়ে গার্ডার ওঠানোর সময় নিচ দিয়ে যাওয়া প্রাইভেটকারের ওপর গার্ডারসহ ক্রেনটি পড়ে গেলে সেখানেই প্রাণ যায় পাঁচজনের। মুহূর্তেই তছনছ হয়ে যায় দুটি পরিবারের স্বপ্ন।
অথচ নিয়ম অনুযায়ী, সেখানে থাকার কথা ছিল সেফটি এরিয়া এবং বিবেচনা নেয়া দরকার ছিল গার্ডার সক্ষমতা। কিন্তু এর কিছুই দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠান মানেনি।
শুধু ওই ঘটনা নয়, এমন বহু ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে ঢাকাসহ সারা দেশে। অর্থাৎ অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সুস্থ অবস্থায় বাসা থেকে বের হলেও ঠিক সেই অবস্থায় আবার বাসায় কেউ ফিরতে পারবেন কি না-তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। কখনও বাধ্য হয়ে, কখনও বা অভ্যাসবশত সবাই অমান্য করছে ট্রাফিক আইন। তবুও সচেতনতা ফিরছে না অধিকাংশের মধ্যে।
সড়কে কোন দুর্ঘটনা ঘটলেই সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে কথা ওঠে। রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে ২০১৮ সালে দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহতের পর পুরো দেশে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন শুরু হয়। এর আগেও সড়ক নিরাপদ করতে বহু আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু কার্যত কোনো পরিবর্তন আসেনি। দেখা যাচ্ছে, ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতাই সড়ককে অনিরাপদ করে তুলছে।
রাজধানীসহ পুরো দেশের সড়ক-মহাসড়ক পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, পরিবহন চালক আর পথচারী- কেউই নিয়ম-কানুনের ধার ধারেন না। খেয়ালখুশিমতো চলেন তারা। হেডফোন কানে লাগিয়ে বা হাতের নাগালে ফুটওভারব্রিজ রেখে অভ্যাসগত দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে চলন্ত যানবাহনের সামনে পড়ে যাওয়া তো হরহামেশাই ঘটছে। এতে বাড়ছে পথচারীদের মৃত্যুর মিছিল।
অন্যদিকে রুট পারমিট ও ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে রাস্তার মাঝখান থেকে যাত্রী ওঠানো-নামানোয় সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজটের। হাতে গোনা কিছু সংখ্যক বাসের অনুমোদন নিয়ে এক একটি কোম্পানি শতাধিকের বেশি বাস পরিচালনা করছে রাজধানীতে। শহরের মধ্যে নিদিষ্ট বাসস্ট্যান্ড থাকলেও সেখানে দাঁড়াতে যেন অনীহার শেষ নেই। আবার বাসের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অবৈধভাবে রাস্তার দুপাশে এলোমেলোভাবে গাড়িগুলো দাঁড় করিয়ে রেখে সরু রাস্তাকে আরও সরু করে ফেলেছে তারা। যেখানে সেখানে গাড়ির ইউটার্ন নেয়া, সড়কের ওপর এবং ফুটপাতে দোকান তো আছেই। আর বাসের দিকে তাকালে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি যে নিত্যদিনের ঘটনা সেটা বুঝতে আর গবেষণার দরকার হয় না।
মোটের ওপর নিজের গন্তব্যের চিন্তা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা মনে হয় কারও মাথায় কাজ করে না। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এ দেশে এখন যে যত কৌশলে ট্রাফিক আইন অমান্য করতে পারবে, সে ততই তাড়াতাড়ি তার গন্তব্যে পৌঁছবে। আর যে আইনের প্রতি যত শ্রদ্ধাশীল হবে গন্তব্যে পৌঁছতে তার ততবেশি সময় লাগবে।
অপরদিকে রাস্তায় চলতে গেলে প্রতিনিয়ত জীবন নিয়ে শঙ্কা জাগে। ফলে সড়কে বিশৃঙ্খলা একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ কারণেই বাড়ছে দুর্ঘটনা।
ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানের বিষয়ে যোগাযোগবিদরা বলছেন, পথচারীদের পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ টেকসই ও পরিবেশসম্মত কোনো সমাধান নয়। কিন্তু বিভিন্ন সময় মানুষের দাবির মুখে, কখনও আন্দোলন সামাল দিতে অথবা দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখাতে যত্রতত্র এসব ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে নাগরিকদের সুবিধার বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এআরআই) সহযোগী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ সময় সংবাদকে বলেন, দেশে বিদ্যমান ট্রাফিক আইন সবাই যদি সঠিকভাবে মনে চলে তাহলে প্রায় ৩০ শতাংশ অব্যবস্থাপনা দূর করা সম্ভব।
তার মতে, পথচারী পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত না। আমাদের দেশের ফুটওভার ব্রিজগুলো তৈরি করা হয় সক্ষম মানুষদের কথা চিন্তা করে। ফলে সবাই উঠতে পারে না। অথচ ব্রিজগুলোতে চলন্ত সিঁড়ি ও র্যাম্প থাকবে। যেখানে সক্ষম-অক্ষম সবাই পারপার হবে।
তিনি বলেন, দুই মোড়ের মাঝামাঝি জায়গায় ফুটওভার ব্রিজ করতে হবে। যেখানে ব্রিজগুলো তৈরি করা হচ্ছে সেখানে মানুষের পারাপার কম। আবার তা বানানোর পরে সার্বক্ষণিক তদারক করতে হবে। যার কিছুই আমাদের দেশে হচ্ছে না।
অন্যদিকে পথচারীরাও সচেতন হচ্ছেন না। এমন অবস্থায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো বেশ চ্যালেঞ্জিং বলেই মনে করেন সাইফুন নেওয়াজ। তাই পুরো সিস্টেমকে পরিবর্তন করতে সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে।
এ বিষয়ে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এআরআই) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক সময় সংবাদকে বলেন, দুর্ঘটনার অনেক কারণ থাকে। সব সময় চালকের দোষে দুর্ঘটনা ঘটে-এমন চিন্তা একটা অসুস্থ চিন্তা। এটা প্রকৃত কারণ না। এটা উপসর্গ।
তিনি বলেন, চালকের যেমন ভুল আছে, তেমনি বিআরটিএর ভুল আছে, যারা সড়ক নির্মাণ করেন তাদের গাফিলতি ও ভুল আছে, যারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে তাদেরও ভুল আছে; মালিকেরও ভুল আছে। তবে এর মধ্যে চালকদের ভেতর যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা এটা সবচেয়ে বড় কারণ বলে আমরা দেখতে পাই।
রাজধানীর মূল সড়ক থেকে রিকশা তুলে দেয়ার পাশাপাশি মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে করতে বললেন এআরআইর পরিচালক ড. অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তার মতে, ট্রাফিক আইন অমান্য করার ক্ষেত্রে এ দুটি যান বড় ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে লেন না মানার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া সাইকেল লেনও আলাদা করার দাবি জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, রিকশা ও মোটরসাইকেল চালকদের কোনো প্রশিক্ষণই থাকে না। তারা নিজেদের মতো করে এসব বাহন চালানো শিখে রাস্তায় নেমে যায়। ফলে ট্রাফিক সিস্টেম সম্পর্কে তাদের ধারণা খুবই কম থাকে। বিশেষ করে রাইড শেয়ার সিস্টেম আসার পর আইন ভাঙা মোটরসাইকেল চালকদের কাছে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেই জানালেন এ অধ্যাপক
জনবহুল ঢাকায় পথচারী চলাচল বা পারাপারে তেমন কোনো সুবিধা রাখা হয়নি। কিছু জায়গায় সেই সুবিধা থাকলেও পথচারীদের উদাসীনতায় তা কোনো কাজে আসছে না। এ ছাড়া রাজধানীতে অপ্রয়োজনীয় জায়গায় ফুটওভারব্রিজ তৈরির পাশাপাশি ভাঙা ফুটপাতে হাঁটার অবস্থা নেই বললেই চলে। আবার এই ফুটপাতেই বসানো হয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি, টেলিফোন বক্স ও নামানো হয়েছে ফুটওভারব্রিজের সিঁড়ি।
তবে কিছু ক্ষেত্রে পথচারীর দায় থাকা সত্ত্বেও আইনি পদক্ষেপে কখনও পথচারীকে দায়ী করা হয় না। এমনকি জরিমানা ও মোবাইল কোর্ট বসিয়েও পথচারীদের শৃঙ্খলায় আনতে এবং সচেতন করতে সরকারের কোনো চেষ্টাই এখন পর্যন্ত খুব ফলপ্রসূ হয়নি।
এটা নেই, ওটা নেই বলে দেশের নাগরিকদের অভিযোগের কোনো শেষ নেই। কিন্তু সংকট আর অনিয়মের সব দায় প্রশাসনের ওপর চাপিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেদের দায়িত্বটুকু এড়িয়ে চলেন সড়ক ব্যবহারকারীরা। ফলে তাদের হাতে অনেক সমস্যার প্রাথমিক সমাধান থাকলেও বদলায় না আচরণ বদলায় না সড়কের চিত্র।
জটিল এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পুলিশ খুঁজছে সমাধানের পথ। সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচির পাশাপাশি সবাইকে নিয়মের মধ্যে আনতে চলছে পরিকল্পনা।
এজন্য সবার আগে জনসচেতনা বাড়ানোর ওপর জোর দিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিকের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান। তিনি বলেন, ট্রাফিক সিগন্যাল মানতে চান না অধিকাংশ যানবাহনের চালক। সবসময় চলে আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। জরিমানা করেও তাদের এই প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। আবার রাস্তা পারাপারে এক থেকে দুই মিনিটও অপেক্ষা করতে চান না পথচারীরা। ফুটওভারব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহার করতে অনীহা প্রকাশ করেন। এজন্য জনসমাগম বুঝে এবং রাজধানীর বড় বড় মোড়গুলোতে সার্কুলেটেড ব্রিজ করতে পারলে সেটা সবার জন্যই ভালো হবে।
তিনি বলেন, শুধু ট্রাফিক পুলিশের ওপর দায় দিলে চলবে না। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপদ সড়কের জন্য বিআরটিএ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। জনসাধারণকেও সচেতন করতে হবে। ট্রাফিক আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। তাহলে শৃঙ্খলা আসবে।