Saturday , December 21 2024
Breaking News

আইনমন্ত্রী বললেন মামলার জট কমানো গেলে মানুষের আস্থা দৃঢ় হবে

দেশের আদালতগুলোতে প্রায় ৪০ লাখ মামলার জট রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে মামলার জট কমানো ও বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা ধরে রাখাকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। 

বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের নিজ কার্যালয়ে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি। এ ছাড়া আইনমন্ত্রী বিচার বিভাগের ডিজিটাইজেশন, ই-জুডিশিয়ারি, সাক্ষ্য আইন সংস্কার নিয়ে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন।  প্রশ্ন : এখন দেশের আদালতগুলোতে মামলার জট প্রকট আকার ধারণ করেছে। মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে?

আনিসুল হক : মামলার জট সমস্যা নতুন নয়। ৫০ বছর আগের সমস্যা, যা দিন দিন প্রকট হয়েছে। এই সমস্যা দূর করতে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। এখন দেশে যত মামলা বিচারাধীন রয়েছে তার সংখ্যা কমিয়ে আনাটাই, অর্থাৎ এখন যেখানে আছে, যে সংখ্যা আছে তার সংখ্যা কমিয়ে আনা, যাকে বলে রিভার্স করা। এটাই এখন আমার বড় চ্যালেঞ্জ। দেখুন, আমরা (আইন মন্ত্রণালয়) পদক্ষেপ নিয়েছিলাম যে ২০২০ সালে দেশে মামলার সংখ্যা আগে যা ছিল, তা থেকে ছয় লাখ কমিয়ে আনা, কিন্তু করোনার কারণে তো সব কিছুই বন্ধ হয়ে গেল। ফলে আমাদের উদ্যোগ আর কার্যকর করতে পারলাম না। একটা মামলাও কমাতে পারলাম না। পরে ভাবলাম, ২০২১ সালে এটা করব। এরই মধ্যে আট মাস চলে গেছে, কিন্তু সেই করোনার কারণে আমাদের পদক্ষেপ বাস্তবায়নে কিছু করতে পারলাম না। এখন আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।

আমাদের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল—তা হলো দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া। আপনারা দেখেছেন, যেখানেই স্পর্শকাতর কোনো অপরাধ হয়েছে, যেটা মানুষ ও সমাজকে নাড়া দিয়েছে, সেখানেই বিচার বিভাগ ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রসিকিউশন, বিচারক তথা বিচার বিভাগ, আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেখুন, ফেনীর মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলা, বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যা, শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাস চাপা পড়ে নিহত হওয়া, পায়ুপথে গ্যাস ঢুকিয়ে শিশু হত্যা—এসব ঘটনায় করা মামলা অত্যন্ত ত্বরিত গতিতে বিচার সম্পন্ন করতে পেরেছি। আইনের সব দিক, অর্থাৎ সব নিয়ম-কানুন পালন করেই বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে। এই যে দ্রুত বিচারের প্রথা চালু হয়েছে, এটা যাতে অব্যাহত থাকে, মানুষ যাতে হতাশ না হয়, বিচার বিভাগের ওপর আস্থা থাকে, সেটাও কিন্তু একটা বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে মামলার জট কমানো, আরেক দিকে বিচার বিভাগ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তা দ্রুত সমাধান করে বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা আরো দৃঢ় করাই আমার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন : গোটা বিশ্ব যখন করোনাভাইরাস মহামারিতে স্থবির, চারদিকে মৃত্যু, আতঙ্ক। পরিস্থিতি মোকাবেলায় লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার শর্ত রয়েছে। মানুষের চলাচল সীমিত। সেই সময় বাংলাদেশে ভার্চুয়াল ব্যবস্থায় আদালত কার্যক্রম চালু রাখা হলো। ঠিক কী কারণে সরকার এই উদ্যোগ নিল?

আনিসুল হক : সব সময়ই অপরাধ সংঘটিত হয়। আর এই অপরাধ দমনে আইনের শাসন চালু রাখার জন্য সব সময়ই একটা ব্যবস্থা রাখতে হয়। যাতে মানুষ আস্থা রাখতে পারে যে কোনো অন্যায় হলে, অপরাধ হলে তার প্রতিকার পাওয়া যাবে, বিচার পাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, বিচারের ক্ষেত্রে কোনো স্থবিরতা আনা যাবে না। আমরা গত ১০০ বছরে কোনো অতিমারি দেখিনি। সর্বশেষ অতিমারি স্প্যানিশ ফ্লু। এ অবস্থায় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেখলেন, আদালতগুলো বেশিদিন বন্ধ রাখা যাবে না। আদালত দীর্ঘদিন বন্ধ রাখলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াবে যে অপরাধ হবে, বিচার হবে না। যাদের অপরাধ করার সন্দেহে ধরা হয়েছে, তাদেরও জেলখানায় থাকতে হবে। আর যাঁরা বিচার চাচ্ছেন, তাঁরাও বিচার পাবেন না। এমনটা হলে একটা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এই পরিস্থিতির থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অবশ্যই একটা আইন এবং বিচার বিভাগকে সচল রাখার জন্য একটি ব্যবস্থা প্রয়োজন। ঠিক এ কথা ভেবেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আদালতগুলো ভার্চুয়ালি চালানোর বিষয়ে আমাকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনার আলোকেই আমরা ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার আইন’ করেছি। এর ফলে তখন কারাগারে যে চাপ এবং আদালতগুলোতে মামলার যে চাপ ছিল, তা সঙ্গে সঙ্গে নিরসন করা গেছে। এই ভার্চুয়াল আদালতব্যবস্থার মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য আমরা সফল হয়েছি। এখন আমরা এটাকে একটা স্থায়ী রূপ দেওয়া যায় কি না, তা চিন্তা করছি।

দেখুন, এই ভার্চুয়াল পদ্ধতির ব্যাপারে আইজীবীদের মধ্যে একটা ভয় ছিল। তবে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর সে ভয় কেটে গেছে। সফলভাবে এই পদ্ধতিটা প্রয়োগ করা গেছে। আইনজীবীরা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন বলেই ভার্চুয়াল আদালতব্যবস্থায় আমরা সফলতা পেয়েছি। তাই এখন সশরীরে উপস্থিতির পাশাপাশি ভার্চুয়াল আদালতও আমরা করতে পারি কি না, তা চিন্তা করছি। হয়তো এমন একটা সময় আসবে, অনেক ভয়ংকর আসামি, যাকে আদালতে নিলে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। তাকে কারাগারে রেখেই বিচার করা প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে আমরা ভার্চুয়াল আদালত কাজে লাগাতে পারব। যদি ভার্চুয়ালি আসামিকে কারাগারে রেখে বা সাক্ষীকে অন্য কোথাও রেখে বিচারকাজ চালাতে হয়, সাক্ষীর জবানবন্দি বা জেরা কিভাবে করা যাবে, সেটা গ্রহণযোগ্য করতে হলে কী কী করতে হবে, এসবের জন্য সাক্ষ্য আইন সংশোধনের প্রয়োজন আছে। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনকে আরো আধুনিক করতে হবে। সাক্ষ্য আইন যখন করা হয় তখন কিন্তু ভার্চুয়াল বিষয়গুলো সাক্ষ্য আইনে ছিল না। সে জন্য আমরা সাক্ষ্য আইনটা সংশোধন করব। সাক্ষ্য আইনটাকে আরো যুগোপযোগী করে, সময়োপযোগী করে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্যগ্রহণের ব্যবস্থা আইনসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য করার উদ্যোগ নিয়েছি। জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনেই এটা করার চিন্তা ছিল, কিন্তু করোনার কারণে তা এগোয়নি। সাক্ষ্য আইন সংশোধন করতে হলে সব সংসদ সদস্যের অংশগ্রহণ ও স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন আছে। এ কাজ শুরু হয়েছে। মতামত নেওয়ার পর আগামী অধিবেশনে এর একটা খসড়া উপস্থাপনের চেষ্টা থাকবে। আমরা এটাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। 

প্রশ্ন: আপনি অনেকবারই দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অভিযোগ করেছেন। এখন আপনি মন্ত্রী। এখন কি এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা গেছে?

আনিসুল হক : এর প্রধান সাক্ষী সাংবাদিকরাই। আপনারা দেখেছেন, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামক কালো আইনের মাধ্যমে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার বিচার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, কিন্তু এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। যে মামলার বিচার শেষ করতে ৩৪ বছর লেগেছে। জেল হত্যা মামলাও সম্পন্ন হয়েছে। সেটারও বিচার সম্পন্ন হতে ৩৪ বছর লেগেছে। জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। একাত্তরে আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের বিচার সেখানে হয়েছে। এই বিচার চলমান রয়েছে। এগুলো কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতির অংশ ছিল। এসব অপরাধের বিচার যখন হচ্ছিল না তখন মানুষ বলত এ দেশে বিচার হয় না। এখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি রয়েছে। এখন এসব মামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ায় মানুষের মনে একটা বিশ্বাস জন্মেছে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বিচারপ্রাপ্তির সংস্কৃতিতে পৌঁছেছে। এখন এটাকে আরো সুদৃঢ় ও সুসংহত করতে মামলার জট কমানো গেলেই বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা আরো অনেক দৃঢ় হবে।

প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম কি শুধুই আগস্ট মাসে সীমাবদ্ধ থাকে?

আনিসুল হক : আগস্ট মাস এলেই এ বিষয়ে সাংবাদিকরাই আমাদের প্রশ্ন করে থাকেন। অন্য সময় তাঁরা এটা নিয়ে কিছু বলেন না, কিন্তু শুধুই আগস্ট নয়, সারা বছরই আমাদের কাজ চলমান থাকে। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা সারা বছরই করে থাকি। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। তাদের ফিরিয়ে আনতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যতক্ষণ না তাদের সবাইকে তথা শেষজন পর্যন্ত ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে পারছি, ততক্ষণ আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। ইনশাল্লাহ, তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে। 

About Monir Hossain

Check Also

আ.লীগ ও সহযোগীদের কাছে লোক চেয়েছে যুবলী

সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আগামীকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় জমায়েতের উদ্যোগ নিয়েছে যুবলীগ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি যখন …

Leave a Reply

Your email address will not be published.