সারাদেশের বিভিন্ন মহাসড়কে বাসে যাত্রী উঠিয়ে, যাত্রীবেশে বাসে উঠে কিংবা সড়কে গাছ ফেলে ডাকাতির ঘটনা নতুন নয়। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। অর্ধশত গ্রুপ নানা কৌশলে এসব কাজে সক্রিয় রয়েছে। সম্প্রতি ‘গন্তব্য পার্টি’ নামে একটি চক্র মহাসড়কে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের টার্গেট করে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে সর্বস্ব। কেউ বাধা দিলে তাদের হাত-পা ও মুখ বেঁধে চলন্ত মাইক্রোবাস থেকে ফেলে দেয়া হচ্ছে। কখনো খুন করতেও তারা পিছপা হয় না।
এই চক্রের ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের গুলশান বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গন্তব্য পার্টি দুই শতাধিক ছিনতাই ও বেশ কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে। এ কাজে তারা ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, টঙ্গী-গাজীপুর, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে টার্গেট করছে। যখন মহাসড়কের যাত্রী মেলে না, তখন রাজধানীর মধ্যেই তারা ছিনতাই করছে। তাদের যাত্রী ওঠানোর কৌশলও অভিনব।
রাজধানীর বিভিন্ন বাস কাউন্টারে যেসব যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের পাশে গিয়ে অবস্থান নেয় চক্রের ২-৩ জন সদস্য। ‘গাড়ি সংকটে বিশাল ভোগান্তি থেকে কবে রেহাই মিলবে?’ এমন কথোপকথন দিয়ে শুরু হয় ওই যাত্রীর সঙ্গে ভাব জমানোর পর্ব। একপর্যায়ে জানতে চাওয়া হয় গন্তব্য সম্পর্কে। সরল বিশ্বাসে কেউ গন্তব্য বলে দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে সামনে এসে দাঁড়ায় একটি মাইক্রোবাস। পরে সেটির চালক ওই গন্তব্যে কেউ যাবে কিনা বলে ডাকতে থাকে। ভাড়া বলা হয় বাসভাড়ার সমান। তখন ওই যাত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চক্রের সদস্যরা বলতে থাকে, ‘বাস কখন আসবে তার ঠিক নেই। বাসভাড়ার সমান টাকা যখন চাচ্ছে, চলুন মাইক্রোতেই চলে যাই।’ ওই যাত্রী মাইক্রোবাসে উঠলে কিছু দূর নিয়ে হাত-পা বেঁধে লুটে নেয়া হয় সর্বস্ব। পরে তাকে নির্জন জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।
শুধু তাই নয়, কাউন্টারে ভিড় দেখলে পুরো গাড়ি ভরেই ওঠানো হয় যাত্রী। পরে মহাসড়কের নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা চক্রের সদস্যরা সব যাত্রীর মোবাইল ও টাকাসহ সর্বস্ব লুটে নেয়। এসব ঘটনায় তেমন কেউ মামলা করতে আগ্রহী না হওয়ায় দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল চক্রটি। এখনো এই চক্রের ৫ সদস্য ছিনতাইয়ে সক্রিয় রয়েছে, যাদের বাড়ি বরগুনার আমতলী ও পটুয়াখালীতে। গাড়ি নিয়ে ঢাকা এসে যাত্রীদের উঠিয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়ে আবার তারা এলাকায় চলে যায়।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর এই গন্তব্য পার্টির খপ্পড়ে পড়েন শফিক হোসেন (ছদ্মনাম)। তাকে একই কায়দায় মাইক্রোবাসে তুলে রাজধানীর ৩০০ ফিট এলাকায় নিয়ে ছুরি ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ১ লাখ ৭ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। পরে তার হাত-পা বেঁধে রূপগঞ্জ থানাধীন কাঞ্চন ব্রিজের পাশে ফেলে রেখে যায় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় তিনি ডিএমপির খিলক্ষেত থানায় একটি মামলা (নম্বর-১৫) দায়ের করেন।
গত ১৭ ও ২৫ অক্টোবর ধারাবাহিক অভিযানে চক্রের অন্যতম হোতা দেলোয়ার হোসেন ওরফে সল্টু, কামাল মৃধা ও আলমগীর খাঁ নামে ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জব্দ করা হয় তাদের ব্যবহৃত মাইক্রোবাস।
রিমান্ডে নেয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা ডিবিকে জানিয়েছে, ২০০৬ সাল থেকে ৮ জনের একটি দল নিয়ে তারা মহাসড়কে ডাকাতি ও ছিনতাই করে আসছে। ২০১২ সালে ডাকাতির সময় এক যাত্রী (ভিকটিম) বাধা দিলে ‘সেলাই রেঞ্চ’ দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। মৃত অবস্থায় তাকে বিমানবন্দরের নিকটবর্তী কাওলা এলাকায় ফেলে চলে যায়। পরে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের অন্যতম দেলোয়ার (যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত) এবং আলমগীর (১০ বছর দণ্ডপ্রাপ্ত)।
২০২০ সালের শেষে তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারো দলকে সংগঠিত করে ডাকাতি শুরু করে। তাদের নামে ঢাকা ও বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় একাধিক মামলা রয়েছে। তারা মহাসড়কে দুইশর বেশি ছিনতাই করেছে বলে জানিয়েছে।
গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া ডিবির ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) এস এম রেজাউল হক ভোরের কাগজকে বলেন, খিলক্ষেত থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলার সূত্র ধরে এই চক্রের সন্ধান মেলে। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের আরো বেশ কয়েকজন সদস্যের নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
অভিযোগ করেন না ভুক্তভোগীরা : হাইওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় সারাদেশে ৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৬ জন এজাহারনামীয়সহ ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, নিয়মিত ছোট ধরনের ডাকাতি ও অহরহ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও অভিযোগ করেন না ভুক্তভোগীরা। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ জানতেই পারে না কোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে কিনা। মহাসড়কে সক্রিয় থাকা এসব চক্রকে আইনের আওতায় আনতে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দায়ের করার অনুরোধ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।