ইরানে চলমান যে আন্দোলন সেটি এখন আর কেবল নারী আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ নেই। কারণ মাহশা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে নেমে আসা নারীদের সাথে যুক্ত হয়েছে সেদেশের পুরুষেরাও। বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠেছে সংহতির সমাবেশ।
এই যে ইরানে নারীদের পোশাক নিয়ন্ত্রণের আইন করা হয়েছে এবং সেই আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে “নৈতিক পুলিশ” বাহিনী এটি কি কেবল একটি অধিকারের ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ নাকি এর মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রকাশ? গোটা বিশ্বে এখন নারী পুরুষের সম্মিলিত এগিয়ে যাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছে। জাতিসংঘ বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের নানাবিধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। SDG (Sustainable Development Goal) এর অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়নের সাথে নারীর সকল প্রকার স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করার বিষয়টি সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। বাংলাদেশের মতো ইরানও জাতিসংঘের সদস্য। অর্থাৎ, জাতিসংঘ ঘোষিত সকলপ্রকার উন্নয়ন কর্মসূচির তারাও অংশীদার। কিন্তু ঘটনা আসলে কী ঘটছে? গোটা বিশ্ব যা করছে ইরানে চলছে তার উল্টো।
এই শরীয়া আইনের আওয়াজ কিন্তু আমাদের দেশেও দুইদিন পরপর একটি গোষ্ঠী তুলে থাকে। খেলাফত কায়েমের স্বপ্ন নিয়ে ভেতরে ভেতরে আমাদের যুবসমাজকে একটি অবাস্তব দুনিয়ার সদস্য বানাচ্ছে তারা। পাড়ায় পাড়ায় তরুণ ও যুবকদেরকে টার্গেট করে গড়ে তুলছে ব্রিগেড। তরতাজা তরুণদেরকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে কেবল পরকালের সুখের হাতছানি দিয়ে। সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে ইতিমধ্যেই কিছু তরুণ নিখোঁজ আছে এবং ৭ জন তরুণকে গ্রেফতার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এরা কারা? এরা সেই ইরানী পন্থার রাষ্টব্যবস্থার স্বপ্নধারণকারী গোষ্ঠী। কেন? কীসের টানে আমাদের তরুণরা এমন বিপথে চলে যাচ্ছে?
নারীর পোশাককে কেন্দ্র করে রাস্তায় রাস্তায় হেনস্তাকারীরা কারা? এই তারাই কিন্তু একটা সময়ে মোরাল পুলিশ বাহিনীর সদস্য হতে চাইবে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে হাজার হাজার বছর পুরনো রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্ন নিয়ে আমাদের তারুণ্যকে কি এগিয়ে দিচ্ছে না পিছিয়ে দিচ্ছে? ইরানে নারীদের পাশাপাশি পুরুষেরাও নেমেছে রাস্তায়। খেলাফত কায়েমেই যদি মানুষের মুক্তি ঘটতো তাহলে আজকে ইরানে কেন এতো মানুষের প্রাণহানি ঘটছে? ইতিমধ্যেই শত ছাড়িয়েছে মানুষের মৃত্যু। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র উদ্বেগ জানিয়েছে সে ঘটনায়। যদিও ইরানের রাষ্ট্রপ্রধান অভিযোগ করেছেন যে এই আন্দোলনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হাত আছে। কিন্তু বহিঃশক্তির হাতের উছিলা কি ইরানের ভেতরে ভেতরে গড়ে উঠা জনরোশের বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে দেয়?
বাংলাদেশ একটি জনরাষ্ট্র অর্থাৎ, এই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক হচ্ছে এদেশের আপামর জনগণ। আইন প্রণেতারা এই জনগণের প্রতিনিধির কাজ করে মাত্র। কিন্তু আমাদের জনসাধারণ কি এই রাষ্ট্র কাঠামোর কোনো পরিবর্তন চায়? রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ এখনও একটি অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন বলেই পরিচিত। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানেরা উদারনৈতিক রাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী। আর এই প্রকাশ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘের সভায় ঘোষিত নানা পদক্ষেপ। জনগণ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রের এই উদারনীতিকে ধরে রাখতে সাহায্য করা। মৌলবাদী নীতির কাছে যেন আমাদের নীতিনির্ধারকরা পরাজিত না হয় সেদিকটাকে নিশ্চিত করতে পারে একমাত্র সাধারণ মানুষ।
আমরা সবাই জানি যে আমাদের দেশে সবসময়েই কোনো বিষয়ে সবাই একমত হয় না। স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিখণ্ডিত এই জাতি। একদল আছে যারা এই দেশকে মুক্ত দেখতে চায় না। তারা সবসয়েই চায় বাংলাদেশ পরাজিত থাকুক। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়াতে পিছপা হয় না তারা। ইরানের আন্দোলন তাই আমাদের এই খেলাফতকামী মানুষদের কাছেও একটি শিক্ষা হতে পারে। তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের পরে আর আগের ইরানের চেহারা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। বদলে যাওয়া ইরানের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ অংশটি হচ্ছে সেদেশের নারীরা। এতো কঠিন ও কঠোর আইন ও নিয়মের বিধি এর আগে কোনোদিন নারীরা ভোগ করেনি। সামান্য চুল দেখা যাওয়ার অপরাধে একজন মানুষকে জেলে পুরে অত্যাচার করে মেরে ফেলার মতো ঘটনা যেকোনো সভ্যদেশকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমাদের দেশেও কি এধরনের ঘটনা ঘটছে না? হয়তো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হচ্ছে না কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে ঘটছে। “মোরাল পুলিশিং” এর মতো দৃষ্টান্ত অহরহই ঘটে চলেছে। কিছুদিন আগেও নরসিংদী রেলস্টেশনে একজন নারীকে তার পোশাকের জন্য যে নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে সেটি কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না। তার মানে আমাদের দেশেও বেসরকারিভাবে নৈতিক পুলিশিং এর কাজটি করে যাচ্ছে একটি বেসরকারি বাহিনী। এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে দ্রুতই। আশার কথা যে রাষ্ট্র এধরনের ঘটনাকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছে না। আইনের আওতায় আনা হচ্ছে অপরাধীকে কিন্তু এমন একটি ঘটনাও বিপজ্জনক এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য।
ইরানের ঘটনাকে আমি মনে করি “আই ওপেনিং” বা “ওয়েইক আপ” কল। একটি সভ্য রাষ্ট্র কোনোদিনও পেছনে হাঁটতে পারে না। আর নারীদেরকে শৃঙ্খলে বেঁধে কোনো রাষ্ট্র সামনে আগাতে পারে না বা আধুনিক বলে দাবি করতে পারে না। বাকি বিশ্ব কী করবে জানি না কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ থেকে সরকার সবার জন্যই সাবধান হবার দরকার আছে বলেই মনে করি। নারীকে বন্দি করলেই মুক্তি আসে না বরং মুক্ত স্বাধীন চলাফেরার নিশ্চয়তাই পারে সঠিক মুক্তি নিয়ে আসতে।