দেশজুড়ে ডেঙ্গুু ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, যতই দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবশেষ গত বুধবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, ডেঙ্গু এখন আশঙ্কাজনক হারে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকাসহ ৫০ জেলায় ডেঙ্গু দেখা দিয়েছে। ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশি।
ডেঙ্গু জ্বরে সতর্কতার জন্য এই রোগ সম্পর্কে জানার বিকল্প নেই। শরীরে কোন কোন লক্ষণ দেখলে আপনি বুঝবেন যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এবং সে ক্ষেত্রে আপনার করণীয় কী হতে পারে, তা জেনে নিন। আসুন জেনে নেই ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো। সারাবাংলাকে ডেঙ্গু নিয়ে তথ্যগুলো জানিয়েছেন চিকিৎসক আদনান আহমেদ রবিন।
ডেঙ্গুর সময়কাল
সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। কারণ, এ সময়টিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরের সময়কাল আরো এগিয়ে এসেছে। এখন অবশ্য জুন মাস থেকেই ডেঙ্গু জ্বরের সময় শুরু হয়ে যাচ্ছে।
মশা কামড়ানোর সূচী
ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা অন্ধকারে কামড়ায় না। সাধারণত সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে ওঠে। মনে রাখবেন, এডিস মশা কখনো অন্ধকারে কামড়ায় না। তাই দুপুরে ঘুমানোর সময়ও সতর্ক থাকুন। বিশেষ করে শিশুদের সাবধানে রাখুন। সম্ভব হলে দিনের বেলা শরীর ভালোভাবে কাপড় দিয়ে ঢেকে ঘুমান; প্রয়োজনে মশা নিরোধক ব্যবহার করুন। দিনে ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে বা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমান।
ডেঙ্গুর লক্ষণ
ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১-১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর টানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে। এর সঙ্গে শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, চেখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ (র্যাশ) হতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে। জ্বর হলে সারা শরীরে লাল ফুসকুড়ি দেখা যায়, যাকে ত্বকের ফুসকুড়ি বলা হয়, অনেকটা অ্যালার্জির মতো। বমি বমি ভাব এমনকি বমিও হতে পারে। রোগী অত্যধিক ক্লান্তি এবং ক্ষুধা মন্দা অনুভব করে।
হাড় ভাঙার ব্যাথা হয়
ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত প্রচণ্ড জ্বর হয় এবং সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর সাধারণত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে। শরীরে, বিশেষ করে হাড়, নিতম্ব, পিঠসহ জয়েন্ট এবং পেশিতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। কখনও কখনও ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় হাড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম হলো ‘ব্রেক বোন ফিভার’।
কীভাবে ছড়ায়
ডেঙ্গু জ্বর বহনকারী মশা যদি একজন মানুষকে কামড়ায় তাহলে চার-ছয়দিনের মধ্যেই ডেঙ্গু জ্বর হবে। আবার জীবাণুমুক্ত মশা আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ালে তা-ও ডেঙ্গুর বাহক হয়ে ওঠে। এভাবেই মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়।
জ্বরকে অবহেলা নয়
যেহেতু এখন ডেঙ্গুর সময়, সে জন্য জ্বর হলে অবহেলা করা উচিত নয়। জ্বরে আক্রান্ত হলেই সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যান। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তারা জ্বরকে অবহেলা করেছেন। জ্বরের সঙ্গে যদি সর্দি-কাশি, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কিংবা অন্য কোনো বিষয় জড়িত থাকে, তাহলে সেটি ডেঙ্গু না হয়ে অন্য কিছু হতে পারে। তবে জ্বর হলেই সচেতন থাকতে হবে।
বিশ্রাম গুরুত্বপূর্ণ
এই সময়ে জ্বর হলে বিশ্রামে থাকতে হবে। সেটা ডেঙ্গু হোক বা অন্য জ্বর। জ্বর নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা উচিত নয়। একজন ব্যক্তি সাধারণত প্রতিদিন যেসব পরিশ্রমের কাজ করে, সেগুলো না করাই ভালো। এই রোগীর পরিপূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন।
জ্বর থেকে সারতে
জ্বর হলে প্রচুর পরিমাণে তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে। যেমন, ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস এবং খাবার স্যালাইন খেতে পারেন। এমন নয় যে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে, পানিজাতীয় খাবার খেলেই হবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ নয়
এই সময়ে জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন-জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় অ্যাসপিরিন-জাতীয় ওষুধ খেলে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। প্যারাসিটামলের সর্বোচ্চ ডোজ হচ্ছে প্রতিদিন চার গ্রাম। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ চারটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে। কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট ও কিডনি-সংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
প্লাটিলেট কাউন্ট চিকিৎসকের ওপর ছেড়ে দিন
ডেঙ্গু হলেই সবাই প্লাটিলেট কাউন্ট বা রক্তকণিকা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্লাটিলেট বা রক্তকণিকা এখন আর মূল ফ্যাক্টর নয়। তাই বিষয়টি চিকিৎসকের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। সাধারণত একজন মানুষের রক্তে প্লাটিলেট কাউন্ট থাকে দেড়-লাখ থেকে সাড়ে চার-লাখ পর্যন্ত।
অধিকাংশ রোগী বাসাতেই সুস্থ হন
ডেঙ্গু জ্বর মানেই যে হাসপাতালবাস- এটা কিন্তু সঠিক নয়। ডেঙ্গুর তিনটি ভাগ রয়েছে। ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’। প্রথম ক্যাটাগরির রোগীরা স্বাভাবিক থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ‘বি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের সবই স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু শরীরে কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন, তার পেটে ব্যথা হতে পারে, বমি হতে পারে প্রচুর কিংবা সে কিছুই খেতে পারছে না। অনেক সময় দেখা যায়, দুদিন জ্বরের পরে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল ভর্তি হওয়াই ভালো। ‘সি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর সবচেয়ে খারাপ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউর প্রয়োজন হতে পারে।
ডেঙ্গুর প্রতিরোধ
ডেঙ্গু ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই এই ভাইরাস মোকাবিলার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো প্রতিরোধ। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতাই প্রাথমিক হাতিয়ার। সরকার ও জনগণের সমন্বিত সচেতনতাই পারে আমাদের এই মহামারি থেকে নিরাপদ রাখতে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাই এডিস মশার বংশবৃদ্ধি ও উৎপত্তির দিকে নজর দিতে হবে।
পানি জমতে দেবেন না
ডেঙ্গু ঠেকানোর অন্যতম উপায় আপনার আশেপাশের জমানো পানি পরিষ্কার করা। ‘ভদ্র ’ হিসেবে পরিচিত এডিস মশা সুন্দর ঘরবাড়িতে বাস করে। ময়লা পানিতে নয়, ডিম পাড়ে স্বচ্ছ পানিতে। বাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দার ফুলের টবে, ব্যবহৃত ফ্রিজের নিচে, এসির নিচে জমে থাকা পানিতে, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা টায়ার কিংবা অন্যান্য পাত্রে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। তাই খুব সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কোথাও তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি পানি জমা না থাকে।