রাজধানী ঢাকার নাভিশ্বাস এখন অবৈধ গাড়ি পার্কিং। বৈধ পার্কিং না থাকায় কোথায় কোথাও রাস্তার দুই তৃতীয়াংশ দখল হয়ে থাকছে থেমে থাকা যানবাহনে। এতে সৃষ্ট যানজট হয়ে উঠছে আরও অসহনীয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নগর ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা কিছু পথ দেখিয়েছেন। তবে তা বাস্তবায়নে আন্তরিক হতে হবে সরকারকে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সীমানা বেড়েছে। রাজধানীর বাইরে থেকেও প্রতিদিন আসছেন অসংখ্য মানুষ। কিন্তু এতো গাড়ি রাখার জায়গা নেই ঢাকায়।
সম্প্রতি মিরপুর-২ নম্বর, চিড়িয়াখানা, মিরপুর- ১০, ১১,১২ ও মিরপুর-১৪ নম্বরের বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে দেখা গেছে, ছয় লেনের রাস্তার তিন থেকে চার লেনই পার্কিং করা গাড়ির দখলে। মিরপুর-১২ নম্বর এলাকায় সড়কের দু’পাশে রবরব, শিকড়, প্রজাপতি, স্বাধীনসহ রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস পার্কিং করে রাখা হয়েছে। মিরপুরের দুয়াড়িপাড়ায় প্রধান সড়কে আশীর্বাদ, বিহঙ্গ পরিবহন সড়কের অর্ধেক জায়গা দখল করে রেখেছে। একই অবস্থা চিড়িয়াখানার প্রধান সড়কেও। সেখানে তানজিল, বিহঙ্গ, খাজাবাবা, নূর এ মক্কা পরিবহনের বাসগুলো সড়ক দখল করে পার্ক করা আছে।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিনই গাড়িগুলো পার্ক করে রাখছে চালকরা। বিশেষ করে বাজার এলাকায় সবসময় যানজট লেগেই থাকে। আর চালকরা বলছেন, মালিকদের পক্ষ থেকে গাড়ি রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই ট্রিপ শেষে তারা রাস্তার পাশে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।
একই অবস্থা মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকাতেও। রাজধানীসহ দেশের দূরপাল্লার বাসগুলো সড়কের দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হচ্ছে। আর সেগুনবাগিচা ও অফিসপাড়া হিসেবে পরিচিত মতিঝিলের অবস্থা আরও ভয়াবহ।
বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনে থেকে শুরু করে রেল ভবনের শেষপ্রান্ত ও প্রেস ক্লাব পর্যন্ত সড়কের ওপর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি, ব্যক্তিগত গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার্কিংয়ে রাখা হয়। নটরডেম কলেজের সামনের সড়কে প্রাইভেটকার, বাস-ট্রাক, লরিসহ নানা ধরনের যানবাহন পার্কিং করে রাখা হয়। এ ছাড়া ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে শুরু করে কারওয়ান বাজার হয়ে মোতালিব প্লাজা-এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যাল ও কাঁটাবন হয়ে নীলক্ষেত পর্যন্ত রাস্তার ওপর নানা ধরনের যানবাহন পার্ক করে রাখা হয়। একই অবস্থা ফার্মগেট থেকে সিটি কলেজ মোড় পর্যন্ত। মামলা দিয়েও ওই এলাকার সড়কে পার্কিং ঠেকানো বন্ধ করা যাচ্ছে না।
সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ৪৭ ধারায় বলা আছে, সরকার বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক পুলিশের পরামর্শে মোটরযান পার্কিং এলাকা নির্ধারণ করতে পারবে। নির্ধারিত এলাকা ছাড়া পার্কিং করা যাবে না, যদি কেউ করে তা হবে অপরাধ। এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। একই সঙ্গে চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কর্তন করা হবে। যদিও এখন পয়েন্ট কাটার নিয়ম কার্যকর নেই।
পুলিশের ভাষ্য মতে, আইন অনুযায়ী তারা জরিমানা করতে পারে না। শুধু রেকার দিয়ে থানায় নিয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আইন অনুযায়ী পুলিশ শুধু গাড়িগুলোকে রেকার লাগিয়ে সরিয়ে নিতে পারে। মামলা বা জরিমানা করতে পারে না। ৪৭ ধারায় জরিমানা করতে পারে ভ্রাম্যমাণ আদালত।’
সমাধান দেখাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা
অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য চালক নয়, বরং নগরের অব্যবস্থাপনাকেই দুষছেন নগর বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক আদিল মুহাম্মদ খান। কলকাতা নিউ টাউনের উদারহণ টেনে তিনি বলেন, সেখানে সবগুলো ফ্লাইওভার দারুণভাবে সাজানো গোছানো আর রঙিন। এসব ফ্লাইওভারের নিচে বাচ্চাদের খেলার জায়গা, স্ট্রিট থিয়েটার ও বসার জায়গা রয়েছে। যেটি আমাদের দেশেও করা সম্ভব। এজন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে বলেও জানান তিনি।
আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, ঢাকার ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। কোথাও ময়লার ভাগাড় হয়েছে। কোথাও বা নেশাখোরদের আস্তানা। দেয়ালঘেরা অপ্রয়োজনীয় মিডিয়ান ভেঙে সেখানে পরিকল্পিত গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে নগরীতে গাড়ি পার্কিংয়ের অনেকটাই সমাধান হবে।
আর পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানের মতে, শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে পার্কিং ব্যবস্থা ছাড়া গড়ে ওঠা ৯০ ভাগ ভবন সংস্কার করতে হবে। যেটি বর্তমান সময়ে অনেকটাই অসম্ভব। তাই সরকারকে প্যাটারনস্টার পার্কিংয়ের দিকে ঝুঁকতে পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি। তার মতে, এটা অনেকটা নাগরদোলার মতো। ঢাকায় যেহেতু জায়গা কম, তাই এ পদ্ধতি শহরের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী।
অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান সময় সংবাদকে জানান, সাধারণ সময়ে দুটি গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য যে জায়গা লাগে, প্যাটারনস্টার পদ্ধতিতে একসঙ্গে সেই জায়গাতেই ১৮ থেকে ২০টি গাড়ি পার্ক করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, এ পদ্ধতিতে খরচ কম। তিন থেকে পাঁচ দিনে তৈরি করা সম্ভব
বেশি বহুতল ভবনের বাণিজ্যিকভাবে স্পেস ভাড়া দেয়া হয় ঘণ্টা চুক্তিতে ছোট গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য।
রাজধানীর মতিঝিলের ৩৭তলা সিটি ভবনের ৭তলা, মতিঝিলে সাধারণ বীমা অফিসের উল্টো দিকে এমটি ভবনে ছয় তলা পর্যন্ত, ধানমন্ডির অরচার্ড পয়েন্টের আন্ডারগ্রাউন্ড এবং ওপরের ২য় তলা পর্যন্ত, উত্তরার গ্রিন লাইফ কার পার্কিং সেন্টারের চতুর্থ তলা পর্যন্ত, ছয় তলা বিশিষ্ট রমনা মাল্টিলেভেল কার পার্কিং সিস্টেম, গুলশান-২ এর পিংক সিটি কার পার্কিং সেন্টারের চার তলা, গুলশান-১ এর জব্বার টাওয়ারের পেছনে সানমুন কার পার্কিং সেন্টার, পল্টনের বাইতুল ভিউ টাওয়ার, মালিবাগের হোসাফ টাওয়ার, এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা টাওয়ার, মধ্য বাড্ডার পার্কিং কই ইঙ্ক লিমিটেড, ইসলামপুরের গুলশান আরা সিটি পার্কিং গাড়ি রাখার জন্য বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেয়া হয়।