কাপড়ে সুই-সুতার ফোড়ন তুলে নকশিপণ্য তৈরি করে প্রত্যন্ত জলঢাকার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিণ বেরুবন্দ গ্রামের কয়েকশ নারী নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন এনেছেন। একসময়ের অভাবী এসব নারী আজ শুধু নিজেরাই স্বাবলম্বী হননি, পুরো সংসারে এনেছেন সচ্ছলতা।
জলঢাকা উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রামে নকশিপণ্য তৈরির কারখানা শঙ্খচিল কুটির। ঢাকা টঙ্গীর তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী জারিন তাসনিম। ২০২০ সালে ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত করেন এই শঙ্খচিল কুটির। বিয়ে করে শহর থেকে প্রত্যন্ত এই গ্রামে আসার পর ২০২০ সালে অক্টোবর মাসে বাবার মৃত্যুতে নিজেকে একেবারেই অসহায়বোধ করেন। এ সময় স্বামীর উৎসাহ ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর মহিলা কল্যাণ সংস্থার ট্রেইনার মায়ের কাছে নেয়া শিক্ষায় মাত্র ১০ জনকে নিয়ে শুরু করেন নকশির কাজ। প্রথমে বেবিপণ্য তৈরি করে শুরু করেন বাজারজাত। অনলাইনের মাধ্যমে শুরু হয় বেচাকেনা। পরে ক্রমান্বয়ে গ্রুপ করে গ্রামের মেয়ে ও নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কারিগরে পরিণত করেন।
দক্ষিণ বেরুবন্দ গ্রাম ও পাশের গ্রামের সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মেয়ে ও নারীরা এখন আর কেউই বসে থাকে না। বেকার নারীরা সার্বক্ষণিক ও অবসর সময়ে মেয়েরা নকশিপণ্য তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
প্রত্যন্ত গ্রামের গৃহবধূ জারিন তাসনিম এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, একসময় এই নকশিপণ্য মানুষের কাছে খুবই সমাদৃত ছিল। কালের পরিবর্তনে এর কদর কমতে থাকে। আমি সেই নকশির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে, এলাকার গরিব দুঃখী নারীর অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে ও নিজের মানসিক অবসাদ কাটাতেই সে সময় শুরু করি নকশির কাজ। তিনি আরও বলেন, নীলফামারী অঞ্চলে বাল্যবিয়ের হার বেশি, এখানে নারী নির্যাতনের সংখ্যাও বেশি। নারীরা প্রতিটি পদে পদে নির্যাতনের শিকার হয়। নারী সমাজের উন্নয়নে, তাদের আর্থিক সচ্ছলতার পথ তৈরি করে দিতে এবং বাল্যবিয়ের হার কমাতে সর্বোপরি নিজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতেই আমি এই কাজ শুরু করি। প্রথমে এই কাজের জন্য এখানে কোনো কারিগর পাওয়া যেত না। আমি প্রথমে বাড়ির আশপাশের ১০ জন নারীকে প্রায় এক মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে ট্রেইনার তৈরি করি। এই ট্রেইনারই পর্যায়ক্রমে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রায় ৪ শত কারিগর তৈরি করেন। তারাই এখন মূলত আমার কর্মচারী।
কর্মরত স্কুলের এক ছাত্রী বলেন, আমরা এখানে কাজ করে স্কুলের খরচ বাদ দিয়েও বাবা-মায়ের সংসারে সহযোগিতা করে থাকি। স্কুল এবং পড়ালেখা শেষ করেই অবসর সময়ে এই হাতের কাজ করি।
নারী শ্রমিক স্বপ্ন, রাবেয়া, রানী, কুলসুম বলেন, স্বামীদের আয়ে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই ছিল। ছেলেদের লেখাপড়া করাতে পারতাম না। এখানে কাজ করে আমার এখন প্রতি মাসে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা আয় করি। ফলে সংসারে কিছুটা হলেও সচ্ছলতা এসেছে।
নীলফামারী বিসিরে উপব্যবস্থাপক হুসনে আরা খাতুন বলেন, নারীরা সব পেশায় এগিয়ে এলেও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে এখনো। আমাদের লক্ষ্যই হলো নারীদের প্রমোট করা। আমরা নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এবং সহজ শর্তে ব্যাংক লোন পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করি।
শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের বেরুবন্দ গ্রাম ও পাশের আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রায় সাড়ে ৪০০ মহিলা এই শঙ্খচিল কুটিরের ব্যবস্থাপনায় কাজ করে প্রতি মাসে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা আয় করছেন।নারীনীলফামারীনকশাস্বাবলম্বী