Monday , December 30 2024
Breaking News

বঙ্গবন্ধু যখন নিষিদ্ধ রাহাত খান সংবাদপত্রে তখন সচেষ্ট হয়েছিলেন

বড় নীরবে নিভৃতে ইহলোক ত্যাগ করলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক রাহাত খান। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকাশ্য প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে মানুষ যখন স্থবির জড় পদার্থ, তখন সেই স্থবিরতা কাটাতে যে ক’জন কবি সাহিত্যিক সচেষ্ট হয়েছিলেন তন্মধ্যে রাহাত খান অন্যতম।

১৯৭৭ সালের অমর ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্মরণে “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়” শীর্ষক একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?” প্রবন্ধটি লিখেছিলেন দেশবরেণ্য কবি শামসুর রাহমান। সংকলনটিতে প্রকাশিত ইত্তেফাকের এককালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রাহাত খানের লেখাটিও ছিল দুঃসাহসিক।

রাহাত খানের ভাষায় যীশু খৃস্টের আত্মাহুতি, মহাত্মা গান্ধীর আত্মদান এবং মার্টিন লুথার কিংয়ের আত্মাহুতির মতো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডও বাঙালি জাতিকে নতুন সংকল্পে স্থির করেছে, নবতর শপথে অটল ও দৃঢ় করেছে। ইতিহাসে তার স্থান সেইসব বিরল সংখ্যক মহাপুরুষের পর্যায়ে, যারা জাতির জনকের অভিধায় ভূষিত।
আমাদের অনেকের সৌভাগ্য, এইকালে জন্ম নিতে পেরেছিলাম। রাহাত খান লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের মানুষ স্তদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেমন এজিদের হাতে ইমাম হোসেনের শাহাদাৎ চোখের জলে নিরব বেদনায় মেনে নিয়েছিল সারা মুসলিম জাহান।

প্রসঙ্গত, অপ্রকাশিত শোক যন্ত্রণা প্রথম প্রকাশ পায় কবি নির্মলেন্দু গুণের “আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি” শীর্ষক কবিতাটিতে। কবি শামসুর রাহমান লিখেন, “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়”। পরবর্তীতে এই শিরোনামে একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়।

শামসুর রাহমান লিখেছেন, “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মাটির তলায় চাপা দিয়ে রাখা যায়নি। এক অর্থে তিনি সগৌরবে উঠে এসেছেন কবর থেকে, উঠে এসেছেন তার প্রিয় বাংলাদেশে, ফসলের আভায়, কৃষকের হাসিতে, নদীর স্রোতে, মাঝির ভাটিয়ালি গানে, উত্তর বঙ্গের গাড়িয়াল ভাইয়ের ভাওয়াইয়া গানে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারী মিছিলে, সভায়। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি আজ উদ্ভাসিত স্বমহিমায়।

কবি শামসুর রাহমান প্রয়াত হয়েছেন। চলে গেলেন রাহাত খানও। বেঁচে আছেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী কবি নির্মলেন্দু গুণ। নির্মলেন্দু গুণ বলেন, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর অনেকদিন চলে গিয়েছিল, দেশের ভিতরে কোথাও প্রকাশ্যে কেউ তাঁর নাম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। ১৯৭৭- এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমি যে কবিতাটি পাঠ করি ” আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি” সেটি আমি লিখেছিলাম বেশ কিছুদিন আগেই।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা আমাকে তখনও ঐ কবিতাটি পাঠ করার অনুমতি দেননি। তারপর ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে জন্মগ্রহণ করা, জনগণের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিতে একুশের ভোরের কবিতা পাঠের আসরে আমি ঐ কবিতাটি পাঠ করার সিদ্ধান্ত নিই এবং অনুষ্ঠানে সমবেত সকলকে চমকে দিয়ে আমি ঐ কবিতাটি পাঠ করি। কবিতা পাঠান্তে আমার বুকের মধ্যে চেপে- বসা একটি পাথর অপসারিত হয়।

নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটি এরকম- সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালবাসি, রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শেষ দুটি লাইন হলো – আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি, আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম। অবশ্য নির্মলেন্দু গুণ বলেন, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তাকে নিয়ে প্রথম কবিতাটি রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের একজন মানুষ, যাকে আমরা কেউ কবি হিসেবে জানি না। হয়তো ভাবেনওনি কোনদিন কবিতা লিখবেন। কিন্তু ভবিতব্য তার হাত দিয়েই লেখিয়ে নিলো এক অবিস্মরণীয় ঐ কবি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাল্যসুহৃদ! তার নাম মৌলভী শেখ হালিম। আরবি ভাষার শিক্ষক। তার কবিতার দুটি লাইন হলো- হে মহান, যার অস্থি-মজ্জা, চর্বি ও মাংস এই কবরে প্রোথিত।

যাই হোক “এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?” শীর্ষক সংকলনটিতে লেখা দিতে অনেকেই অপারগতা প্রকাশ করেন। কবি আসাদ চৌধুরী বলেছিলেন,’এখন এসব ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’ এরকম অনেকের কাছেই লেখা চেয়ে বিমুখ হয়েছিলেন দৈনিক সংবাদের আবদুল আজিজ। খেলাঘর আসরের কবি সিরাজুল ফরিদ সংকলন প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন।

শিল্পী মানিক দে সংকলনটির কভার আঁকেন। কভারে প্রতীক হিসাবে আঁকা হয় বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত মোটা ফ্রেমের চশমা। কভার শিল্পী হাফটোন ব্যবহারের মাধ্যমে দু’টি ইম্প্রেশনের কৌশল করেন চার রং ছাপার জন্য। কভারে উপর থেকে নিচে কোণাকুনি হাফটোনে লেখা ” এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়”। দৈনিক সংবাদে রাত দুটার দিকে ছাপা হয় সংকলনটি।

এসব কাজে ভুমিকা রাখেন ভীষ্মদেব চৌধুরী, নূর-উদ্- দীন শেখ, নবেন্দু চৌধুরী। দুঃসাধ্য কাজে নেপথ্যে বিশিষ্ট ভুমিকা রাখেন বামপন্থী রাজনীতিক মঞ্জুরুল আহসান খান এবং খেলাঘরের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন আহমেদ, সাহিত্যিক রাহাত খান, মহাদেব সাহা, হায়াৎ মাহমুদ, মাশুক চৌধুরী,আখতার হুসেন, মাহমুদুল হক, মোহাম্মদ রফিক, জাহিদুল হক, জিয়াউদ্দিন আহমেদ, কামাল চৌধুরী, কবি দিলওয়ার, শান্তিময় বিশ্বাস, নূর- উদ্- দীন শেখ, ওয়াহিদ রেজা, ইউসুফ আলী এটম, খালেক বিন জয়েন উদ্দিন, ফজলুল হক সরকার, ভীষ্মদেব চৌধুরী, তুষার কর , ওয়াহিদ রেজা, ফরিদুর রহমান বাবলু, আলতাফ আলী হাসু।

জাসদ সমর্থক লুৎফর রহমান রিটন শুধু লেখাই দেননি তিনি লেখার প্রুফও দেখেন। চূড়ান্ত প্রুফ দেখেন আবদুল আজিজ। সংকলনে অন্নদাশংকর রায়ের যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা….. কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান শীর্ষক কবিতাটির অংশ বিশেষ প্রকাশিত হয়।

সংকলনটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলা একাডেমিতে এটি বিলি করা হয়। পাঁচ টাকা দিয়ে সংকলনটি প্রথমে ক্রয় করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। সংকলনের সম্পাদনায় নাম যায় সূর্য তরুণ গোষ্ঠী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আওয়ামী লীগের তৎকালীন আহবায়ক সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন দুঃসাহসিক কাজের জন্য ৫০০ টাকা দিয়ে সংকলনটির একটি কপি ক্রয় করেন। পরবর্তীতে কলকাতা থেকে পুনর্মুদ্রিত হয়। বলা বাহুল্য,আজ দেশবিদেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কতশত সংকলন, লেখকের নেই অভাব। কিন্তু সেদিন.?

About Banglar Probaho

Check Also

আ.লীগ ও সহযোগীদের কাছে লোক চেয়েছে যুবলী

সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আগামীকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় জমায়েতের উদ্যোগ নিয়েছে যুবলীগ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি যখন …

Leave a Reply

Your email address will not be published.