Saturday , December 21 2024
Breaking News

আর্থিক সংকটে বেসামাল ইউরোপ কি ইউক্রেনের পাশ থেকে সরে যাবে

ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়েছিলেন ইউরোপের দেশগুলোর নেতারা। যুদ্ধক্ষেত্রে মস্কোকে একহাত নিতে কিয়েভকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন তাঁরা। তবে যুদ্ধ শুরুর আট মাসের বেশি সময় পার হওয়ার পর পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। ইউরোপে শুরু হয়েছে শীতের দাপট। দেখা দিয়েছে জ্বালানিসংকট, হু হু করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম।

এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। ফলে সামনের দিনগুলোতে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারে ইউরোপ। সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, আথিক সংকটের মুখে ইউরোপের দেশগুলো কি ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করবে? এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে।

রাশিয়ার জ্বালানিসম্পদের ওপর ইউরোপের বড় নির্ভরশীলতা রয়েছে। ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানো ইউরোপের দেশগুলোকে ধরাশায়ী করতে এই নির্ভরশীলতাকে কাজে লাগাচ্ছে মস্কো। বসে নেই ওই দেশগুলোও। রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি বন্ধ করতে চাইছে তারা। চেষ্টা করছে রাশিয়ার তেল–গ্যাসের বিকল্প কোনো উৎস খোঁজার। এমনকি চলতি শীতে সংকট মোকাবিলায় জ্বালানি সাশ্রয়ে নানা কৌশলও এঁটেছে তারা।

সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে জার্মানি। চেকোস্লোভাকিয়ায় সরকারি অফিসগুলোতে পুরোনো বাল্ব সরিয়ে বিদ্যুৎ–সাশ্রয়ী এলইডি বাল্ব ব্যবহার করা হচ্ছে। ইতালিতে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কম তাপে খাবার রান্না করতে। ইউরোপের নামীদামি নানা ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতে সময়ের আগেই বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চলতি নভেম্বরে ৮০ শতাংশ গ্যাস মজুত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল ইউরোপের দেশগুলো। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। অনেক দেশ আবার ৮০ শতাংশের বেশি গ্যাস মজুত করেছে। এরপরও সামনের কঠিন শীতের মাসগুলোতে ইউরোপ ইউক্রেনের পাশে  থাকবে কি না, তা দেখার সুযোগ আসতে পারে পুতিনের সামনে।

গত সেপ্টেম্বরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জ্বালানিসংকটে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট। রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তক শহরে আয়োজিত এক জ্বালানি সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে আমরা কিছুই সরবরাহ করব না। গ্যাস, কয়লা, তেল—কিছুই না।’

ইউরোপের দেশগুলোর হাতে মজুত থাকার পরও তাদের রাশিয়া থেকে পাইপলাইনে করে আসা গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ রাফায়েল লস। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, যদি রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহে বাধা আসে, তাহলে ইউরোপের দেশগুলোর বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় এর প্রভাব পড়বে।

এদিকে ইউরোপে আগামী বছর শীত মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। কারণ, উত্তর আমেরিকা, উপসাগরীয় দেশগুলো ও নরওয়ে থেকে আসা জ্বালানি রাশিয়ার জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পুরোপুরি চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রাফায়েল লস বলেন, এমন পরিস্থিতিতে পুতিন আশা করছেন, শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে ইউক্রেনের বিপুল পরিমাণ বাসিন্দা আশপাশের দেশগুলোতে পাড়ি জমাবেন।

এরই মধ্যে গত মাসের মাঝামাঝি থেকে ইউক্রেনে হামলা জোরদার করেছে মস্কো। তাদের দফায় দফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ভেঙে পড়েছে ইউক্রেনের ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ অবকাঠামো। রাফায়েল লসের ভাষ্য, পুতিন যদি চলমান ‘জ্বালানিযুদ্ধ’ কাজে লাগিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে জনবিক্ষোভ শুরু করাতে পারেন; অভিবাসনসংকট জোরদার করতে পারেন এবং ভুয়া তথ্য ছড়ানোয় সফল হন, তাহলে এর প্রভাবে ইউক্রেনে ইউরোপের দেশগুলোর সহায়তার হার কমে যেতে পারে। পুতিন কিন্তু এটাই চাইছেন।

ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাগি গত সেপ্টেম্বরে একই ধরনের আভাস দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘দিন দিন বাড়তে থাকা জ্বালানির দাম অর্থনীতিকে খারাপ অবস্থা থেকে টেনে তোলার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। আমাদের শিল্পকারখানাগুলোর উৎপাদনক্ষমতার ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে ইউক্রেনকে ইউরোপের দেশগুলো সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা ফিরিয়ে নেওয়া হতে পারে।’

ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার ইউক্রেনকে আরও আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। একই সময়ে জীবনযাপনের খরচ মেটাতে পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে দেশগুলোর সাধারণ মানুষের। গত সোমবার ইউরোপে মূল্যস্ফীতি ছিল গড়ে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। এটি নতুন একটি রেকর্ড। গত বছরের অক্টোবরে এটি ছিল ৪ দশমিক ১ শতাংশ।

এসব কারণে ইউরোপের দেশগুলোয় মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। বিগত দুই সপ্তাহে ফ্রান্স থেকে রোমানিয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়তি খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বেশি বেতন দাবি করছেন শ্রমিকেরা। জার্মানিতেও বিক্ষোভকারীরা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সরকারের ওপর চড়াও হয়েছে।  

তবে সামনের দিনগুলো আরও ভয়াবহ হতে চলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। পরামর্শক সংস্থা ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফ্টের ইউরোপবিষয়ক বিশ্লেষক কাপুচিন মে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকে থাকবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাই আমাদের মনে হচ্ছে বিক্ষোভও বাড়বে।’ গত সেপ্টেম্বরে ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফ্টের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জীবনযাত্রার খরচ বাড়ার কারণে বিশ্বের ১০১টি দেশে বিক্ষোভ বাড়ছে।

নিকলাস বালবন বার্লিনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল পাবলিক পলিসি ইনস্টিটিউটের একজন গবেষক। এক নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, যদি ইউরোপের দেশগুলোর সরকার ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানতে না পারে, তাহলে এসব দেশের মানুষ কিয়েভকে আরও সহায়তা দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেবে।

গত কয়েক সপ্তাহে অর্থনৈতিক সংকটের বড় ধাক্কা খেয়েছে ইউরোপ। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছে লিজ ট্রাসকে। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ৪৪ দিন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ট্রাসের নেওয়া বাজেট পরিকল্পনা আর্থিক বাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে পাউন্ডের রেকর্ড দরপতন হয়।  

ইউরোপীয় ইউনিয়নেও মানুষের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। গত অক্টোবরে করা এক জরিপে দেখা গেছে, ফ্রান্সে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে মানুষের সমর্থন কমে ৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত মার্চে এ সমর্থন ছিল ৭১ শতাংশ। জার্মানিতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে মানুষের সমর্থন ৮০ শতাংশ থেকে কমে ৬৬ শতাংশ হয়েছে। অপর এক জরিপে দেখা গেছে, ইতালিতে ইউক্রেনের প্রতি মানুষের সমর্থন ৫৭ শতাংশ থেকে কমে ৪৩ শতাংশ হয়েছে।

রোমভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক নাথালি তোকি মনে করেন, আর্থিক সংকটের জেরে ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা কমিয়ে দিতে পারে। তবে সহায়তা কমানোর ক্ষেত্রে আসল বদলটা আনতে পারে যুক্তরাষ্ট্র; ইউরোপ নয়।

রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনকে ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পরই রয়েছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও পোল্যান্ড। এই তিন দেশ কিয়েভকে মোট ৬০০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পরিমাণটা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চার গুণের বেশি।

এদিকে ৮ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ওই নির্বাচনের ফলাফল ইউক্রেনে ইউরোপের দেশগুলোর সহায়তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন নাথালি তোকি।

নভেম্বরের নির্বাচনে মার্কিন সিনেটে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হতে পারে। তবে প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা জয় পাবে বলে জোরালো আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যদি এমনটা হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা দেওয়ার মতো ক্ষমতা হাতে পাবে রিপাবলিকান পার্টি। একইভাবে ইউক্রেনকে আরও সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে বাধা দিতে পারে তারা।

ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক নাথালি তোকিও এটাই মনে করছেন। তিনি বলেন, ‘যদি ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমে যায়, তাহলে কয়েক মাসের মধ্যেই যুদ্ধে ইউক্রেনের বাহিনী বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।’

About Banglar Probaho

Check Also

আ.লীগ ও সহযোগীদের কাছে লোক চেয়েছে যুবলী

সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আগামীকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় জমায়েতের উদ্যোগ নিয়েছে যুবলীগ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি যখন …

Leave a Reply

Your email address will not be published.