বিমানের প্রশ্ন ফাঁস
কালো রঙের একটি ডায়েরি। এর মালিক বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মোটর ট্রান্সপোর্ট (এমটি) অপারেটর জাহাঙ্গীর হোসেন। তাঁর দক্ষিণখানের বাসা থেকে ওই ডায়েরি জব্দ করা হয়। এর পাতায় পাতায় রয়েছে প্রশ্ন ফাঁসের নানা চমকপ্রদ নথি।
কার কাছ থেকে কত টাকা নিয়ে কাকে দিয়েছেন, সে হিসাব লিখে রেখেছিলেন জাহাঙ্গীর। বিমানের আরেক এমটি অপারেটর মাসুদ হোসেনের সঙ্গে তাঁর অধিকাংশ লেনাদেনা। মাসুদের হাত হয়ে প্রতিষ্ঠানটির ‘ওপর তলার’ কর্মকর্তাদের কাছে প্রশ্ন ফাঁসের বিনিময়ে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ পৌঁছে দেওয়া হতো। ডায়েরির তথ্য বলছে, সর্বশেষ ২১ অক্টোবরের পরীক্ষাই শুধু নয়; এর আগেও প্রতিষ্ঠানটির নিয়োগে একই চক্র সক্রিয় ছিল।
গত ২১ অক্টোবর বিমানের ১২টি পদে নিয়োগের পরীক্ষা ছিল। এর আগের দিনই প্রতিষ্ঠানটির অসাধু কিছু কর্মী প্রশ্ন ফাঁস করে। বিষয়টি জানাজানি হলে কর্তৃপক্ষ নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে দেয়। সে সময় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার ও তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে ডায়েরির মালিক জাহাঙ্গীর ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরই মধ্যে তাঁরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে পাওয়া ডায়েরি আলামত হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। তাতে অনেক কিছুই পরিস্কার হয়ে গেছে। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়েছে। এর তদন্ত করছে ডিবি লালবাগ বিভাগ।
ডায়েরির একটি পাতায় তারিখ লেখা- ৮ এপ্রিল, ২০২২। তার নিচে লেখা- ‘এমটি ও জেএসই (গ্রাউন্ড সার্ভিস ইকুইপমেন্ট) অপারেটরের মোট ১২ লাখ টাকা মাসুদকে বুঝিয়ে দেওয়া হইল।’ টাকা বুঝে পাওয়ার পর তারিখসহ মাসুদের স্বাক্ষর রয়েছে। এর পর মাসুদের লেখা- ‘আমি বুঝিয়া পাইলাম।’
ডায়েরির একই পৃষ্ঠায় ভুল বানানে লেখা আছে- জেএসই প্রার্থীর ব্যাপারে মাসুদকে ২৮ লাখ টাকা দেওয়া হলো। সেটি দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের ১৮ মে। এর পর ২৭ মে প্রার্থীদের কাছ থেকে তুলে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা মাসুদকে দেওয়া হয়।
চলতি বছরের ৩ জুন ডায়েরিতে জাহাঙ্গীর লিখেছেন- ‘৩টি কাজ মাসুদের। টাকার পরিমাণ ১৮ লাখ টাকা। ৩টি কাজ জাহাঙ্গীর। টাকার পরিমাণ ১৮ লাখ টাকা।’ এর মধ্যে ‘স্যার’ লিখে পাশে লেখা- ‘২৪ লাখ টাকা।’ অবশিষ্ট ১২ লাখ টাকা। সেখানে আরও লেখা- মাসুদের কাছে আগে জমা ছিল ৩০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তার মধ্যে কাজ বাবদ ১৮ লাখ টাকা।
গোয়েন্দা পুলিশপ্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর রশিদ বলেন, প্রশ্ন ফাঁস চক্রের আদ্যোপান্ত বের করা হবে। একজন মহাব্যবস্থাপক এই চক্রে সংশ্নিষ্ট ও একই পদমর্যাদার আরেকজনের গাফিলতিতে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, জুয়ার আসর থেকেই এমটি অপারেটর জাহাঙ্গীর অন্যদের কাছে প্রশ্ন পৌঁছে দেয়। ফেরিওয়ালার মতো তারা প্রশ্ন বিক্রি করেছিল।
এ ছাড়া ডায়েরির মধ্যে এমটি অপারেটর পদে ৮ প্রার্থীর নাম ও রোল নম্বর লেখা রয়েছে। প্রত্যেকের পাশে টাকার অঙ্ক উল্লেখ করা আছে। যেমন চাকরিপ্রার্থী আসিফ ইকবালের নামের পাশে ১ লাখ টাকা লেখা রয়েছে। তার রোল নম্বর ০৪৩৭।
জেএসই পদের কথা উল্লেখ করে আরও কয়েকজন প্রার্থীর নাম ও তাঁদের কার কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছেন, তাও বলা আছে। প্রার্থী হিসেবে এই চক্রের তালিকায় ছিল শাহিন আলমের নাম। তাঁর রোল নম্বর ০৫৯১। তাঁর নামের পাশে ২ লাখ টাকা লেখা আছে। ১ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে শামিউল হক, ইয়াছিন আরাফাত ও তরিকুল ইসলামের কাছ থেকে। এ তালিকায় আছে আরও কয়েকজনের নাম।
বিমানের প্রশ্ন ফাঁসকারী আরও ৩০ প্রার্থীকে টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার জন্য কথাবার্তা পাকা করা হয়। ডায়েরিতে তাঁদের নাম রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছেন রুবেল ইসলাম, তারেক রহমান, পারভীন খান রিতু, মশিউর রহমান, সোহেল রানা, সাজ্জাদ হোসেন প্রধান, রাশিমুল হক, রুবেল হোসেন, রুমি আক্তার, মিনারা আক্তার, সোহেল আহমেদ, মাধবী, তৌহিদুর রহমান, লুৎফুর রহমান, ইশান মাহমুদ, মেহেদী হাসান রাজু, মনিরুজ্জামান, সবুজ ব্যাপারী, রাকিব হোসেন, নুর আলম, আবু রহিম, আবুল আল মামুন, আমিনুর ইসলাম, নাহিদা আক্তার, জুয়েল রানা, মোল্লা রজন, মাসুদ পারভেজ, তমা ইসলাম, আহমুদুর রহমান, পলাশ বেদিয়া, আবদুল বারী ও রাকিবুল হাসান।
এ ছাড়া গ্রাউন্ড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে প্রার্থী হিসেবে জাহাঙ্গীরের তালিকায় আছেন নাজমুল হক, মাসুদুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, আবদুল মালেক, মনজুরুল ইসলাম, মহিবুল্লাহ খান, আতিকুর রহমান, নুরুল ইসলাম, আরিফুল ইসলাম, হাসান তালুকদার, আকিদুল ইসলাম, ওয়াহিদ, সাইফুল ইসলাম, সাবিনুর নাহার, কবির হোসেন, নাজিব উদ্দিন মিয়া, সাইফুল ইসলাম ও রাশেদুল্লাহ।
একাধিক আসামির জবানবন্দি ও প্রযুক্তিগত তদন্তে উঠে এসেছে, চক্রটি বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়োগ বাণিজ্য ও প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত ছিল।
অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর ও মাসুদ বিমানের এক মহাব্যবস্থাপকের গাড়ির চালক ছিলেন। ওই মহাব্যবস্থাপক প্রশ্নের ছবি তুলে অনেকের কাছে দিয়েছেন। পরে প্রশ্নপত্র জাহাঙ্গীর ও মাসুদের হাতে যায়। উত্তরায় ৯ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডে গ্র্যান্ড প্লাজা নামক হোটেলে প্রায় নিয়মিত জুয়া খেলেন জাহাঙ্গীরসহ প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মচারী। জাহাঙ্গীর গোয়েন্দাদের বলেছেন, জুয়ার টাকা জোগাতে বারবার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়ান। সর্বশেষ জুয়ার আসর থেকে টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র অনেকের কাছে ডিজিটাল মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন তিনি।