Thursday , September 12 2024
Breaking News

অভিনন্দন সানজিদা, অভিনন্দন বাংলাদেশ

প্রথমবারের মতো সাফ জয়ের আনন্দ মেয়েদের। হিরণ্ময় স্মৃতি হয়ে থাকবে এই সাফল্য

সাফল্য আর সাধনা—দুটি শব্দই শুরু ‘সা’ দিয়ে। মিলটা হয়তো কাকতালীয়, হঠাৎ যা আবিষ্কার করে মনে হলো—এমনই তো হওয়া উচিত। সাফল্যের সঙ্গে সাধনার তো নিবিড় সম্পর্ক। একটির সঙ্গে আরেকটি বিনি সুতোয় গাঁথা। বড় কোনো সাফল্য পেতে যা করতে হয়, তা তো সাধনাই। কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের মেয়েদের বিজয়োল্লাস দেখতে দেখতে যে উপলব্ধিটা আরও তীব্র হলো।

কত ঘাম, কত ত্যাগ, কত প্রতিকূলতা জয় করেই না সাবিনা–সানজিদাদের এই সাফল্য! মাথায় দক্ষিণ এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। এর পেছনে কত বছরের নিরলস পরিশ্রম, একাগ্রতা আর হার না মানা দৃঢ়প্রতিজ্ঞার গল্প। এক শব্দে প্রকাশ করতে চান? সাধনা।

দীর্ঘদিনের সাধনার পর ধরা দেওয়া সাফল্য। উচ্ছ্বাসটা বাঁধভাঙা হওয়াই স্বাভাবিক
দীর্ঘদিনের সাধনার পর ধরা দেওয়া সাফল্য। উচ্ছ্বাসটা বাঁধভাঙা হওয়াই স্বাভাবিক

প্রথম লড়াইটা তো জিততে হয়েছে মাঠের বাইরে। পনেরো–ষোলো বছর আগে বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবল শুরু মূলত ফিফার বাধ্যবাধকতা মানতেই। দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া অনেকের হয়তো জানাই নেই, শুরুর দিনগুলোতে কেমন তীব্র সামাজিক বাধা জয় করতে হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েদের। মেয়েরা শর্টস পরে ফুটবল খেলবে—এটা মেনে নিতেই সমস্যা হচ্ছিল সমাজের রক্ষণশীল একটা অংশের। সেই আপত্তি কখনো প্রকাশিত হয়েছে মিছিলে, কখনোবা হামলা চালিয়ে ম্যাচ পণ্ড করে দেওয়ার মাধ্যমেও। বাংলাদেশের মেয়েদের দক্ষিণ এশিয়া জয়ের মাহাত্ম্য পুরো বুঝতে শুরুর সেই বৈরী দিনগুলোর কথা মনে রাখাটা জরুরি। এখানেই সাবিনাদের এই সাফল্য শুধুই একটা খেলার অর্জন ছাপিয়ে অনেক বড় মাত্রা পেয়ে যায়।

যে সাধনার কথা বলছিলাম, তা চলছে অনেক বছর ধরে। সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরা দিনের পর দিন ঢাকার বাফুফে ভবনে একসঙ্গে থেকেছেন, একসঙ্গে খেয়েছেন, একসঙ্গে অনুশীলন করেছেন, একসঙ্গে দেশে–বিদেশে খেলেছেন। এমন করতে করতে সবাই মিলে হয়ে উঠেছেন একটা পরিবার। ফুটবল ছাড়া কোনো জীবন নেই। ফুটবলটাই যেন জীবন। কঠোর অনুশাসনে শৃঙ্খলাবদ্ধ সেই জীবনকেই হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন মেয়েরা। নেবেনই না কেন, এই ফুটবলই যে বদলে দিয়েছে তাঁদের জীবন। লাতিন আমেরিকার অনেক বিখ্যাত ফুটবলারের যে গল্প, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মেয়ে ফুটবলারেরও তো তা–ই। ফুটবল তাঁদের কাছে দারিদ্র্যপীড়িত জীবন থেকে মুক্তির এক বাহন। অনেকের জন্য পেট ভরে খাওয়ার নিশ্চয়তাও।

সাফল্যের পেছনের কারিগর কোচ গোলাম রব্বানীকে নিয়ে উল্লাস মেয়েদের
সাফল্যের পেছনের কারিগর কোচ গোলাম রব্বানীকে নিয়ে উল্লাস মেয়েদের

এই মেয়েদের মধ্যে সাফল্যের এমন তীব্র ক্ষুধাও হয়তো এ কারণেই। সেই ক্ষুধাই বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতাগুলোতে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে বাংলাদেশকে। কিন্তু এমন শূন্য থেকে শুরু করলে যা হয়, জাতীয় দলের হয়ে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে সাফল্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল না। অনূর্ধ্ব–১৬, অনূর্ধ্ব–১৯ দলে খেলতে খেলতেই যে মেয়েদের নেমে পড়তে হয়েছে জাতীয় দলের হয়েও। এই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ তাই সর্বার্থেই নতুন এক যুগের সূচনা। ইতিহাস মনে রাখলে তো আরও বেশি।

এই টুর্নামেন্টটা তো আসলে ভারত আর নেপালের। এর আগের ৫টি টুর্নামেন্টের ৪টিরই ফাইনাল খেলেছে এই দুই দল, বাংলাদেশ খেলতে পেরেছে মাত্র একবার। দ্বিতীয়বার ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ শুধু শিরোপাই জেতেনি, জেতার পথে হিমালয়ের দেশে নতুন নতুন শৃঙ্গেও পা রেখেছে। এর আগে ১০ ম্যাচেও যে ভারতকে হারানো যায়নি, আগের পাঁচবারেরই চ্যাম্পিয়ন সেই ভারতকে উড়িয়ে দিয়েছে ৩–০ গোলে। ফাইনালের প্রতিপক্ষ নেপালও তো ছিল একই রকম অজেয়। এর আগে ৮ ম্যাচে সোনার হরিণ হয়ে থাকা সেই জয় ধরা দিল ফাইনালে। কারণটা বুঝতে সানজিদা আক্তারের ফেসবুক স্ট্যাটাসটাই মনে হয় যথেষ্ট, যেখানে একটা জায়গায় তিনি বলছেন, ‘স্বাগতিক হিসেবে ফাইনাল খেলা কিংবা স্বাগতিক দলের বিপক্ষে ফাইনাল খেলা সব সময় রোমাঞ্চকর।’ ফাইনালে স্বাগতিক দলকে যেখানে সবাই এড়াতে চায়, সেই দলের বিপক্ষে অতীত কোনো সাফল্য না থাকলে তো আরও বেশি, সেখানে সানজিদা নাকি উল্টো রোমাঞ্চিত। কতটা আত্মবিশ্বাস থাকলে এমন ভাবা যায়! সবাইকে তা জানিয়েও দেওয়া যায়!

মেয়েদের উল্লাসের এই ছবি অনেকদিন গাঁথা থাকবে ফুটবলপ্রেমীদের মনে
মেয়েদের উল্লাসের এই ছবি অনেকদিন গাঁথা থাকবে ফুটবলপ্রেমীদের মনে

ফাইনালের আগে বাংলাদেশ দলের রাইট উইঙ্গারের ওই স্ট্যাটাস রীতিমতো ভাইরাল হয়ে গেছে। হওয়ারই কথা। বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এমন বুদ্ধিদীপ্ত, এমন পরিণত কথাবার্তা আগে কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। যেটির কিছু অংশ তুলে দেব ভেবে আবারও পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে, পুরোটাই তো আসলে উদ্ধৃত করার মতো। তা যেহেতু সম্ভব নয়, দুটি অংশ শুধু বলি। যার একটি পড়তে পড়তে চোখ ভিজে যায়, ‘ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, ১১ জনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।’

মন ছুঁয়ে গেছে সানজিদার এই কথাগুলোও, ‘যাঁরা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেসব স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে এক পাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই।’

তা জিতেছেনও সানজিদারা। নিজেরা জিতেছেন, বাংলাদেশকে জিতিয়েছেন। রঙিন করে দিয়েছেন সাফল্যবুভুক্ষু বাংলাদেশ ফুটবলের রাতটাকে।

অভিনন্দন সানজিদা! অভিনন্দন বাংলাদেশ!

About Banglar Probaho

Check Also

আ.লীগ ও সহযোগীদের কাছে লোক চেয়েছে যুবলী

সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আগামীকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় জমায়েতের উদ্যোগ নিয়েছে যুবলীগ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি যখন …

Leave a Reply

Your email address will not be published.