সংস্কারের জায়গাগুলো সরকার ও আইএমএফ চিহ্নিত করেছে। এখন দেখা যাক কোন কোন উদ্যোগগুলো নেয়,” বলছিলেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে সমঝোতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ; যা অর্থনীতির চলমান চাপ সামলাতে সহায়তার পাশাপাশি বিদেশি অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে নিকট ভবিষ্যতে আরও অর্থায়ন পাওয়ার সুযোগকে প্রশস্ত করবে বলে ভাবা হচ্ছে।
তবে এক দশকের বেশি সময় পর আবার এ আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার দারস্থ হওয়ার সূত্র ধরে তাদের পরামর্শ এবং কিছুক্ষেত্রে শর্ত মেনে আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতের সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে।
ঋণ নিয়ে প্রাথমিক সমঝোতার কথা জানিয়ে বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল সংবাদ সম্মেলনেও তেমনটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। সরকার এসব বিষয়ে আগে থেকেই পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও জানান তিনি।
‘‘আইএমএফ যে শর্তের কথা বলেছে, সেই শর্ত নিয়ে আমরা আগেই কাজ করছিলাম। আমরা ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন নিয়ে কাজ করছি। ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন দেরিতে হলেও হচ্ছে। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে,’’ বলেন তিনি।
তার ভাষ্য, “এসব সংস্কারের জন্য আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম, যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে আইএমএফ ঋণ পেতে যাচ্ছি।’’
এ ঋণ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের কথা ঘুরে ফিরেই এসেছে।
এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকনোমিস্ট কনসালটেন্ট অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংস্কারের জায়গাগুলো সরকার ও আইএমএফ চিহ্নিত করেছে। এখন দেখা যাক কোন কোন উদ্যোগগুলো নেয়। হয়ত আগামী ফ্রেব্রুয়ারি নাগাদ তা জানা যাবে। এ বিষয়ে কোনো পক্ষই পরিষ্কার করে বলেনি।
তার মতে, আইএমএফের সঙ্গে এ ধরনের ঋণচুক্তি বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির।
তিনি বলেন, “এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঋণ প্যাকেজ থাকলে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবি কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে আর মাথা ঘামায় না।’’
এমন ক্ষেত্রে তাদের কাছে কোনো ঋণ চাইলে তারা সহজেই দিয়ে দেয় বলেও জানান তিনি।
ঋণ নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় অবস্থানরত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করে।
|
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এধরনের একটা ঋণ বাংলাদেশের জন্য দরকার ছিল বলে মনে করছেন আইএমএফে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইয়ের এই নির্বাহী পরিচালক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘শর্তাদি নিয়ে কোনো পক্ষই স্পষ্ট কিছু বলেনি। তবে অন্তত আর কিছু না হোক সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সামগ্রিক ব্যবস্থার ওপর একটা আন্তর্জাতিক সুপারভিশন থাকবে।‘’
সরকারের সঙ্গে ঢাকায় দীর্ঘ আলোচনায় আইএমএফ প্রতিনিধি দলকে নেতৃত্ব দেওয়া রাহুল আনন্দও মনে করছেন, বাংলাদেশ এ ঋণ পেলে তা বিদেশ থেকে আরও অর্থায়ন পাওয়াকে সহজ করবে।
ঋণের টাকা পাওয়ার পর বাংলাদেশের ‘অর্থনীতি স্থিতিশীল’ হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তবে এজন্য সরকারকে আর্থিক খাতের সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, যা তারা করছে।“
দুই সপ্তাহের আলোচনা শেষে বুধবার ঋণ দেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিক সুবজ সংকেতের বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় আইএমএফ। সেখানে রাহুল আনন্দ জানিয়েছেন, সংস্কারের পুরো গুচ্ছ প্রস্তাবটি সংস্থার সদর দপ্তরে উপস্থাপন করা হবে। পরিচালনা পর্ষদের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া স্বাপেক্ষে তা বিতরণ শুরু হবে।
এ প্রক্রিয়া শেষ করতে এক থেকে দুই মাস সময়ের প্রয়োজন হয় বলেও সাংবাদিকদের জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে আইএমএফের কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের এ ঋণের বিষয়ে প্রাথমিক সমঝোতার কথা জানান অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল।
এর প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে আগামী ফেব্রুয়ারিতেই, যার পরিমাণ ৩৫২ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার, বলে জানান তিনি।
সংস্কার ও শর্তের বিষয়ে তিনি বলেন, “যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে আইএমএফের ঋণ পেতে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় শর্ত তারা দিয়েছে, সেগুলো আমরা নিজেরাই শুরু করছিলাম।”
সাত কিস্তিতে এ ঋণ পাওয়া যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, শেষ কিস্তি বাংলাদেশ হাতে পাবে ২০২৬ সালে। সুদের হার হবে ২.২ শতাংশ।
সমঝোতার পৌঁছানোর কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘আইএমএফের কাছে সাহায্য চাই। আইএমএফকে আমরা ব্যবহার করছি। সারা বিশ্ব ব্যবহার করে। তারা ঋণ ব্যবস্তাপনা নিয়ে দেখার কাজটি করে।
‘‘বাংলাদেশের সমস্ত তথ্য দেখছে আইএমএফ। আইএমএফ যদি আমাদের সাথে থাকে, যদি তারা ঋণ দিতে একমত হয়; তাহলে বুঝতে হবে তখন পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ ঋণ দিতে না করে না।’’
শর্তের বিষয়ে আরেক প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন আমরা শর্তও পূরণ করতে পারব না, ঋণও পাব না। কিন্তু আমরা ঋণ পেয়েছি।’’
সংস্থার সফরকারী প্রতিনিধি দলটি একের পর এক বৈঠকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিতে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা, ভর্তুকি, সুদহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের প্রধানের বক্তব্যেও ঘুরেফিরে সেই বিষয়গুলো উঠে আসে।
রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে রাহুল আনন্দ বলেন, ‘‘সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য সব সময়ই একই মানদণ্ড অনুসরণ করা থাকে হিসাব পদ্ধতিতে; যা বিপিএম৬ নামে পরিচিত। এটি আইএমএফের নিজস্ব ম্যানুয়াল।“
রিজার্ভের মধ্যে যত দায় থাকে, যা অন্য কোনো উপকরণে স্থানান্তর করা হয়েছে তা রিজার্ভের হিসাবে রাখা হয় না। সহজ কথায় বললে, বৈদেশিক মুদ্রার যে অর্থ ব্যবহারযোগ্য তাই রিজার্ভ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এসময় তিনি জানান, বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব হবে।
“গত মার্চেই আমরা বলেছিলাম বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ কমে আসবে। আসলেই তা হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘‘ আমরা রিজার্ভটি গ্রস হিসাব দেখাই। তারা নিট পজিশন দেখাতে বলেছি। আমরা বলেছি, এখানে লুকাবার কিছু নেই। তাদের কথা মত সময়মতই আমরা বিপিএম৬ পদ্ধতিতে দেখাব।’’
প্রকৃত রিজার্ভ সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমান রিজার্ভ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে নিট তথ্য পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ নভেম্বর দিন শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৪ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার।
গভর্নরের বক্তব্য অনুযায়ী, ৮ বিলিয়ন বাদ গেলে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ হবে ২৬ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার।
ঋণ যাবে কোন খাতে
সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক সমঝোতার ঘোষণার পর আইএমএফের বিবৃতিতে বলা হয়, ৪২ মাসের চুক্তিতে সরকারের নেওয়া ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা হিসেবে এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি ( ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি থেকে ৩২০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় পাবে বাকি ১৩০ কোটি ডলার।
এ ঋণের অর্থ দিয়ে যেসব প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার হাতে নেবে, তার উদ্দেশ্য হবে সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং দুর্দশায় পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিয়ে দৃঢ়, অর্ন্তভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি কমিয়ে আনতেও এই ঋণের অর্থ ব্যয় করা হবে।
ঋণের অর্থ কোন খাতে খরচ হতে পারে এমন প্রশ্নে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘আরএসএফ খাত থেকে এক দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার বোধ হয় বাজেট সাপোর্ট হিসেবে আসে। জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলায় কোনো সহায়তা দিতে হলে সেটা বাজেটের মাধ্যমেই দিতে হবে।
‘‘আর বাকি ইসিএফ বা অন্যটা ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সাপোর্ট হিসেবে থাকবে। এগুলোও তারা এখনও পরিষ্কার করেনি।’’