সড়ক দুর্ঘটনায় কপালগুণে প্রাণে বেঁচে গেলেও লন্ডভন্ড হয়ে যায় মোস্তারী রহমানের জীবন। গর্ভের সন্তানটিকেও বাঁচাতে পারেননি। দেশ-বিদেশের হাসপাতালে এক বছর ধরে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের পর ঘরে ফিরলেও মোস্তারীর সঙ্গী হয় ক্রাচ আর হুইলচেয়ার। ভালো বেতনের চাকরিটাও চলে যায়। দুঃসহ যন্ত্রণায় একসময় আত্মহত্যার কথাও ভেবেছেন। কিন্তু হঠাৎ তাঁর মনে হলো—আত্মহত্যা মানে তো হেরে যাওয়া। হারব কেন! এই অদম্য ইচ্ছাশক্তি, দৃঢ় মনোবল আর সংগ্রাম করে পা ছাড়াই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মোস্তারী রহমান।
মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে পাঁচ বছর আগে পুরোনো একটা ফটোকপিয়ার মেশিন কিনে বাড়ির পাশে বাজারে দোকান খুলে বসেন। সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিং আর ফ্লেক্সিলোড। আর তাতেই তিনি এখন এক সফল উদ্যোক্তা। বগুড়ার বিসিক শিল্পনগরীর ফটকের সামনে রাজাপুর সড়কে ‘সুরাইয়া স্টোর’ নামে একটি দোকান আছে। সেখানে এখন অত্যাধুনিক দুটি ফটোকপি মেশিন, মোবাইল রিচার্জ, মোবাইল ব্যাংকিং থেকে মাসে গড়ে আয় ৩৫ হাজার টাকা। এর বাইরে বগুড়া শহরের চায়নিজ রেস্তোরাঁ ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারি দরে মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার ডিম সরবরাহ করেন। এই ব্যবসা থেকেও মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা লাভ থাকে। এখানেই শেষ না, অনলাইনে পেজ খুলে ঘি, আচার, মধু, বাদামসহ নানা পণ্য বিক্রি করছেন। সেখান থেকেও গড়ে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। সব মিলে মাসে প্রায় লাখ টাকা আয় করছেন বগুড়ার এই হার না–মানা নারী।
-ADVERTISEMENT-
Ads by
দুর্ঘটনার আগে–পরে
মোস্তারী রহমানের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বগুড়া শহরের ফতেহ আলী বাজারে তাঁর ডিমের ব্যবসা ছিল। মা সুলতানা রাজিয়া একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী ছিলেন। তিন বোনের মধ্যে সবার বড় মোস্তারী। ছোট দুই বোনের মধ্যে মোস্তাসিন রহমান বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে সংসার করছেন। আর ছোট বোন মাহবুবা রহমান এ বছর বগুড়া শহরের একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।
বগুড়া সরকারি পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ২০১২ সালে ডিপ্লোমা শেষ করার পর নিজের পছন্দে সহপাঠী সোহেল রানাকে বিয়ে করেন মোস্তারী। বিয়ের পর স্বামী ও মোস্তারী দুজনই উপসহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরি নেন নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরের সিনহা টেক্সটাইলে। মোস্তারী ল্যাবরেটরিতে আর সোহেল ইলেকট্রিক্যাল বিভাগে। দুজনের আয়ে ভালোই চলছিল সংসার। মোস্তারী রহমান তখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ২০১৫ সালের ২২ আগস্ট। বেলা ১১টার দিকে সোহেল রানাকে সঙ্গে করে সিনহা টেক্সটাইলের নিজস্ব চিকিৎসাকেন্দ্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরছিলেন। বাসের অপেক্ষায় সড়কের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা। মোস্তারী রহমান বলেন, ‘হঠাৎ কাঁচপুর ব্রিজের ওপর থেকে বেপরোয়া গতির একটা ট্রাক এসে উঠে পড়ে। এক হাতে ধাক্কা দিয়ে কোনো রকমে সোহেলকে রাস্তার পাশে ফেলে দিই। চোট পেলেও প্রাণে রক্ষা পায় ও। কিন্তু আমার পায়ের ওপর উঠে পড়ে ট্রাকের চাকা। পিষ্ট হয়ে অকেজো হয়ে যায় ডান পা। বাঁ পা হাঁটুর চার ইঞ্চি ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর কিছুই আর মনে নেই।’
বাকি ঘটনা শোনালেন সোহেল রানা, ‘রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে এক দফা অস্ত্রোপচারের পর বাঁ পায়ে রগ কাজ করছিল না। ওই দিনই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে আরেক দফা অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপর স্কয়ার, অ্যাপোলো, ঢাকা মেডিকেল হয়ে মোস্তারীকে নেওয়া হয় বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে টানা দুই মাস। পায়ে তত দিনে পচন ধরেছে। সন্তানের কথা ভেবে ঝুঁকি নিয়েই সিজারিয়ান করেন চিকিৎসকেরা। অস্ত্রোপচারের ২০ ঘণ্টার মাথায় মারা যায় নবজাতক কন্যা।’
পায়ের কাটা পচে আরও অবনতি হলো। ‘চিকিৎসার জন্য আমাকে ভারতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো,’ দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করছিলেন মোস্তারী। ডিমের ব্যবসার পুঁজি আর ধারদেনা করে কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করলেন মা-বাবা। ভারতের ভেলোরে সিএমসি হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। প্রথম দফা টানা চার মাস হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর অস্ত্রোপচার হলো। দ্বিতীয় দফা আরও তিন মাস। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানালেন, কৃত্রিম পা লাগাতে সাড়ে চার লাখ টাকা দরকার। সিনহা টেক্সটাইল, ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ছাড়াও সহকর্মীরা সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। সবার সহযোগিতায় কৃত্রিম পা সংযোজন হলো। দেশে ফিরে কৃত্রিম পায়ে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারতেন না। স্বামীর কোলে চড়ে চলাফেরা করতে হতো। পরে সঙ্গী হলো হুইলচেয়ার আর স্ক্র্যাচ। পঙ্গু হওয়ার কারণে চাকরিতে যোগদান করা আর হলো না। সোহেলও চাকরি ছেড়ে দিলেন।
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
পা হারানোর পর সারা দিন ঘরবন্দী কাটত। মোস্তারী বলেন, ‘বাইরের পৃথিবীটা ক্রমেই অচেনা হয়ে যাচ্ছিল। সারাক্ষণ দুর্ঘটনার স্মৃতি কুরে কুরে খেত। মেয়ে হারানোর কষ্ট ভুলতে পারছিলাম না। মা-বাবা, স্বামীর কাছে বোঝা হয়ে থাকব সারা জীবন? এসব ভেবে একসময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো হারতে রাজি নই। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। নিজের ইচ্ছাশক্তিতে প্রেরণা জোগালেন স্বামী আর মা–বাবা। তাঁদের সহযোগিতায় কৃত্রিম পা নিয়ে চলাফেরার কৌশল শিখলাম। চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে তত দিনে মা–বাবার সংসারে ঋণের বিশাল বোঝা। বাবার ডিমের ব্যবসা প্রায় বন্ধ। ঠিকমতো সংসার চলে না।’
মোস্তারী রহমান বলেন, ‘স্বামী রানার গ্রুপে যোগ দিলেন। মা-বাবা ও স্বামী মিলে আমাকে ২০ হাজার টাকা দিলেন। সেই টাকায় বাড়ির পাশে বিসিক বাজারে মৃত কন্যার নামে ‘সুরাইয়া স্টোর’ নামে একটি দোকান চালু করলাম। ২০১৭ সালে অনেকটা শূন্য হাতে শুরু করা সেই দোকানে এখন নতুন ফটোকপি যন্ত্র ছাড়াও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবস্থা আছে।
ফটোকপিয়ারের ব্যবসার পাশাপাশি রিকশায় খাঁচাভর্তি ডিম নিয়ে শহরের চায়নিজ রেস্তোরাঁয় ডিম সরবরাহ শুরু করেন মোস্তারী রহমান। স্বামীর কোলে চড়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় চালু করেন বিউটি পারলার।
মোস্তারী রহমান বলেন, বাবার ডিমের ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসা নিজে করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সারা দিন দোকানে বেচাবিক্রির ফাঁকেই ফোনে শহরের ৮-১০টি চায়নিজ রেস্তোরাঁ থেকে ডিমের চাহিদা জেনে নিই। বিভিন্ন খামার থেকে মুরগি আর নাটোরের সিংড়া থেকে হাঁসের ডিম সংগ্রহ করেন বাবা। সকাল নয়টার মধ্যে রিকশায় ঘুরে ঘুরে রেস্তোরাঁয় সেই ডিম সরবরাহ করি। এরপর সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দোকানে বসি। ঈদ, নববর্ষ, বিয়ের মতো উৎসবে পারলারেও সময় দিতে হয়।
করোনার সংকটে দোকান বন্ধ করে দিতে হয় ২০২০ সালে। তবে তখনো ভিন্ন উপায়ে ব্যবসা চালিয়েছেন মোস্তারী। অনলাইনে পেজ খুলে বিভিন্ন ধরনের আচার, ঘি ও রকমারি খাবার বিক্রি শুরু করেন। তাই করোনার সময়েও ব্যস্ত ছিলেন এই উদ্যোক্তা।
মোস্তারী বলেন, নারী হয়ে বাজারের মধ্যে ব্যবসা করছি, প্রথম দিকে কেউ কেউ বাঁকা চোখে দেখতেন। কটু কথাও বলতেন। পাত্তা দিইনি। এখন পুরো বাজারের ব্যবসায়ীরা সম্মান করেন। আদর করে ‘মা’ ডাকেন। পাঁচ ‘পি’ নীতিতে ব্যবসা করছি আমি—প্রাইস, প্রোডাক্ট, পারসোনালিটি, প্লেস আর পিপল। চড়াই–উতরাই পেরিয়ে খানিকটা পথ পাড়ি দিয়েছি। সামনে আরও অনেকটা পথ বাকি।