‘জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ন। জীবনের স্বাদ এখানে ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায়। ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’
বিশ শতকে পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে পদ্মা তীরবর্তী কেতুপুর–সংলগ্ন জেলেপাড়ার মানুষের জীবনচিত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এঁকেছিলেন এভাবে। গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের পাড়ে নৌকায় ভাসমান সান্দারপাড়ায় গেলে অনেকটা এমন চিত্রের দেখা মেলে। পাড়াটি যেন একুশ শতকের কেতুপুর।
সান্দারপাড়ার দক্ষিণে রাজধানীর উত্তরার আধুনিক নগরজীবন। উত্তরে শিল্পনগরী টঙ্গীর ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন আর দিনবদলের হাতছানি। কিন্তু এসবের কোনো ছোঁয়াই লাগেনি গ্রামটিতে। উন্নয়ন আর আধুনিকতার খুব কাছে থেকেও তাঁরা বিচ্ছিন্ন। যেখানে নেই বিদ্যুৎসংযোগ; খাওয়ার পানির জন্য সংগ্রাম, রোগ, শোক আর নিদারুণ দারিদ্র্যে কাটে তাঁদের জীবন।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর তীরে সারবাঁধা ৩০ থেকে ৩৫টি নৌকা। একেকটি নৌকায় একেকটি পরিবারের বাস। বৃষ্টির ভাব দেখে সবাই ছোটাছুটি করছে। ভারী বর্ষণের ভয়ে কেউ নৌকাগুলোকে শক্ত করে বেঁধে নিচ্ছেন খুঁটির সঙ্গে। কেউবা রান্নাবান্না, অন্যান্য কাজ থামিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন নৌকার ভেতর। কিছুক্ষণের মাঝেই বৃষ্টি শুরু হলে নিত্যদিনের ব্যস্ততার ছন্দপতন ঘটে পুরো এলাকায়।
কথা হয় সেখানকার সবচেয়ে বৃদ্ধ দম্পতি মো. জলিল (৮৫) ও খুশি বেগমের (৭৮) সঙ্গে। আনুমানিক ৩ ফুট চওড়া আর ৪ ফুট উচ্চতার ছোট্ট একটি নৌকায় তাঁদের থাকা-খাওয়া এবং ঘুম। জলিল কিছুটা অসুস্থ। কথা প্রসঙ্গে খুশি বলছিলেন, ‘আমাগোর মতো গরিব মাইনষের কপালে সুখ নাই। ঝড়-বৃষ্টির দিনে সারা রাইত বইয়্যা থাকি। টানা বৃষ্টি শুরু হইলে তো না খাইয়্যাই থাকন লাগে। আশপাশের মানুষের কত সুখ, কত শান্তিতে থাকে। কিন্তু আমাগোর কপালে আল্লাহ এসব লেহে নাই।’ অসুস্থ স্বামীর দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘লোকটা (স্বামী) অসুস্থ মানুষ, একটু ভালোমন্দ খাওন দরকার। কিন্তু ভালোমন্দ খাইবো কী, ঘরে তো চাইলই নাই।’
এই দম্পতি জানালেন, তাঁরা প্রায় ৫০ বছর ধরে এখানে থাকছেন। তাঁদের মূল বাড়ি ঢাকার কেরানীগঞ্জে। তাঁরা ভূমিহীন। বিভিন্ন ঘাট পেরিয়ে আশ্রয় নেন এখানে। তাঁদের রয়েছে পাঁচ সন্তান। তাঁরাও দরিদ্র। ফলে মা-বাবার দায়িত্ব নিতে পারেন না। তাই জলিল ও খুশি পড়ে আছেন নৌকায়। এই বৃদ্ধ বয়সেও তাঁরা চুরি, লেস ফিতা ফেরি করে বিক্রি করেন পথে–ঘাটে। তাতে যে আয় হয়, তা দিয়েই কোনোরকমে খেয়ে–পরে বেঁচে আছেন তাঁরা।
কথা হয় আরও ১৪ থেকে ১৫টি পরিবারের সঙ্গে। আলাপে আলাপে জানা গেল, পাড়াটিতে এখন পরিবারের সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০টি। সবাই ভূমিহীন। কেউ জন্মসূত্রে, কেউবা এখানে আশ্রয় পেয়েছেন বিভিন্ন ঘাট ঘুরে এসে। তাঁদের ঠাঁই কেবল চার তক্তার নৌকা। এর মাঝে বড় কোনো ঝড় বা নদীতে জোয়ার এলে নির্ঘুম রাত কাটে তাঁদের। শুষ্ক মৌসুমে থাকে দূষিত পানির দুর্গন্ধ ও মশার উপদ্রব। এর বাইরে তীব্র শীত, খাওয়ার পানির সংকট, শৌচাগারের কষ্টসহ নানান রোগশোক যেন তাঁদের অমোচনীয় বিধিলিপি।
এ জনগোষ্ঠীর আদি অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারেননি কেউ। তবে একাধিক স্থানীয় বাসিন্দার মতে, জায়গাটিতে তাঁদের অবস্থান প্রায় ১৫০ বছরের আগে থেকে। তাঁরা পেশায় সওদাগর ছিলেন। বিভিন্ন এলাকায় মালামাল ফেরি করে বিক্রি করতেন। এই পেশায় জড়িত ব্যক্তিদের স্থানীয়রা ডাকতেন সান্দার বলে। সেই নাম থেকে পাড়াটিরও নাম হয়েছে সান্দারপাড়া। এখন প্রায় সবার পেশা বদলে গেছে। কেউ মাছ কাটা, কেউ রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া, কেউবা মানুষের বাসায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আগে পাড়াটিতে তিন শ টির বেশি পরিবার ছিল। অভাব-অনটন আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এরই মধ্যে অনেকে চলে গেছেন।
সন্তান জন্মে নেই আনন্দ–উৎসব
পাড়ার একটি নৌকার বাসিন্দা মো. ওয়াসিম। পেশায় মাছকাটার শ্রমিক। তাঁর দৈনিক আয় ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। তা দিয়েই নৌকায় কোনোরকম কেটে যাচ্ছিল স্বামী-স্ত্রী ও দুই সন্তানের পরিবার। এর মধ্যে হঠাৎ এক ঝড়ে ভেঙে যায় নৌকা। ওয়াসিম পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেন নদের পাড়ের একটি অস্থায়ী স্থাপনায়। সেখানে জন্ম হয় আরও দুই সন্তানের। একদিকে অভাব, অন্যদিকে পরিবারের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি—সব মিলিয়ে আনন্দের পরিবর্তে যেন বিপাকেই পড়েছেন ওয়াসিম।
ওয়াসিম বলছিলেন, ‘৪ নম্বর বাচ্চাটা হওয়ার পর খুব চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। আল্লাহ আমার মতো গরিব মাইনষের ঘরে এতগুলা বাচ্চা কেন দিল, আমি তো নিজেই চলতে পারি না। পরিবারের লোকজন বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু আয় বাড়ে নাই। বাচ্চাকাচ্চাগুলা নিয়া খাইয়া না খাইয়া দিন পার করি।’ সংসারে অভাব থাকার পরও এত সন্তান নিলেন কেন, জানতে চাইলে ওয়াসিমের সহজ উত্তর, ‘ভুলে হইয়্যা গেছে। আমরা বুঝতে পারি নাই।’
পাড়াটি ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পরিবারেই তিনের অধিক সন্তান। এসব পরিবারের সদস্যরা জানালেন, পরিবার-পরিকল্পনাসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে অবগত নন তাঁরা। তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও অনেকের ঘরে জন্ম নিয়েছে অধিক সন্তান। ফলে দারিদ্র্যের কবলে পড়ে সন্তান জন্মের আনন্দের চেয়ে সন্তান নিয়ে খেয়ে–পরে বেঁচে থাকার চিন্তাই বেশি।
আলামিন হোসেন নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘কারও সন্তান হইলে মা-বাবা কত খুশি হয়, চারদিকে আনন্দ পইড়া যায়। কিন্তু আমাগোর এইহানে বাচ্চা হওয়া মানেই বাড়তি খরচের চিন্তা। মা-বাবা আনন্দের চেয়ে বাচ্চাকে বাঁচানো নিয়েই চিন্তায় পড়ে যান।’
পৌঁছায়নি শিক্ষার আলো
এ পাড়ার শিশুদের জন্ম নৌকায়। বেড়ে ওঠাও নৌকাতেই। নৌকা আর পানিবন্দী তাঁদের জীবন। তাই নির্দিষ্ট বাসস্থান, শিশুশিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারের খোঁজ মেলে না তাঁদের জীবনে। কেউ কেউ পড়াশোনার চেষ্টা চালালেও অনেকেই পেরোতে পারে না প্রাথমিকের গণ্ডি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা ১০ বছর বয়সী শিশু জান্নাত বলে, ‘লেখাপড়া করমু ক্যামনে। মা-বাবা তো সংসারই চালাইতে পারে না। হেললাইগ্যা আমিও কাজে যোগ দিছি।’
ইচ্ছা থাকলেও অভাবের কারণে সন্তানদের লেখাপড়া করাতে না পারার আক্ষেপ প্রকাশ করলেন চার সন্তানের জননী রাশিদা বেগম। তিনি বলেন, ‘সন্তানগোরে লেখাপড়া করামো নাকি পেটে ভাত দিমু। আগে তো খাইয়া বাঁচতে অইবো, তারপরে না লেখাপড়া। আমরা তো তিন বেলার খাবারই জোগাড় করতে পারি না।’
সান্দারপাড়া পড়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডে। এখানকার দুর্বিষহ জীবনের কথা স্পষ্ট হয় ওয়ার্ডটির কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন সরকারের কথায়ও। তিনি বলেন, ‘এখানকার মানুষগুলো দীর্ঘদিন ধরেই মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করি। ইতিমধ্যে তাদের জন্য খাবার পানি ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও তাদের জন্য দরকার বড় আকারের সহযোগিতা।’