Tuesday , November 5 2024
Breaking News

বন্যার ঝুঁকিতে পৌনে ৯ কোটি মানুষ

এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে নতুন করে দেড় কোটি মানুষ বন্যার ঝুঁকিতে পড়েছেন। যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। প্লাবনভূমি ও নদী অববাহিকতাগুলোতে মানববসতি এবং অবকাঠামো উন্নয়ন বেড়ে যাওয়ায় এ শঙ্কা বাড়ছে। আর জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে বন্যার ভয়াবহতাকে সামনের দিনগুলোতে তীব্রতর করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে আট কোটি ৭০ লাখ (প্রায় পৌনে ৯ কোটি) মানুষ সরাসরি বন্যাকবলিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এসব মানুষ দেশের ছোটবড় নদীগুলোর দুই কিলোমিটারের মধ্যে বাস করছেন।

এ ছাড়াও বিভিন্ন কারণে মানুষের জন্য বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে। যেমন, নদীর ১-২ কিলোমিটার তীরবর্তী বনাঞ্চল ৯১ দশমিক ৯৮ শতাংশ সংকুচিত হয়ে গেছে। তৃণভূমি ৬ শতাংশ ও অনুর্বর ভূমি কমেছে ২৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ ছাড়াও প্লাবনভূমি, অববাহিকতাগুলোতে বসতবাড়ি ও স্থাপনা নির্মাণ বেড়েছে ১১ শতাংশের বেশি।

উপগ্রহের রাত্রিকালীন আলো (এনটিএল) বা আলোর উজ্জ্বলতা ব্যবহার করে সারা দেশে এ বন্যার ঝুঁকি নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা বাংলাদেশের বার্ষিক উপগ্রহ তথ্যচিত্র পর্যালোচনা করা হয়েছে। দূর অনুধাবন বা রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টায় দুবার ছবি নেয়া হয়েছে—সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা ও রাত ২টা থেকে ৩টা।বিজ্ঞানীরা বলছেন, উপগ্রহের মাধ্যমে তোলা রাতের ছবির পিক্সেলের আলো বিশ্লেষণ করে দেশের কোথায় কোথায় মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে, সে সম্পর্কে ধারণা নেয়া হয়েছে। ছবিতে কোথাও কোথাও আলোর উজ্জ্বলতা বেড়েছে।আলোর উজ্জ্বলতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গবেষক দলের নেতা ও অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান বলেন, আমাদের নগর কিংবা গ্রামীণ অঞ্চলে আলো থাকে। যেসব অঞ্চলে শিল্পকারখানা আছে, সেখানেও আলো থাকে। নাসার বিশেষায়িত একটি উপগ্রহ আছে, যেটা কেবল রাত্রিকালীন আলোর তথ্য চিত্রায়ন করে। অর্থাৎ কোথায় আলো কমেছে, বেড়েছে—তা ধারণ করতে পারে এই উপগ্রহ। এ রকম উপগ্রহ দিয়ে ১৯৯২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত—এই ৩০ বছরের ডেটা নিয়েছি আমরা। কিন্তু এই গবেষণায় ২০০০-২০১৮ সালের তথ্য ব্যবহার করেছি।

উদহারণ দিয়ে তিনি বলেন, যেমন সূর্যের আলোতে সবকিছু দেখা যায়, কিন্তু রাতের আলোতে সবকিছু দেখা সম্ভব হবে না। কেবল কোথায় আলো আছে, তা-ই দেখা যায়। রাতের সেই আলো ধারণ করে তা দিয়ে ছবি তৈরি করে উপগ্রহ। সেই আলো কোথায় বাড়ছে, কোথায় কমছে, আমাদের দেশের প্লাবনভূমিতে আলোর উজ্জ্বলতা কতটা বেড়েছে, গবেষণায় তা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। গবেষণায় রাতের আলোর পাশাপাশি ভৌগোলিক তথ্য, ভূমির ব্যবহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জনসংখ্যার বণ্টন ও বিদ্যুতের সরবরাহ নিয়েও তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপকের মতে, প্লাবনভূমি হচ্ছে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে নদীর পানি আসে। বর্ষায় পানি আসে, শীত এলে তা নেমে যায়। প্লাবনভূমি একেবারে সমতল ভূমি। সেখানে ভূমির তারতম্য খুবই কম। যে কারণে এই ভূমিতে উন্নয়ন খরচও কম পাহাড়ি এলাকার তুলনায়। সেখানে নগর কিংবা শিল্প-কারখানা তৈরি করাও সহজ। যেমন পার্বত্য অঞ্চলে একটি সড়ক বানাতে যে অর্থ খরচ হবে, প্লাবনভূমিতে তা লাগবে না। আর আমাদের দেশের ৮০-৮৫ শতাংশ প্লাবনভূমি যা নদ-নদীর পলিমাটি দিয়ে তৈরি।

আর এ কারণে প্লাবনভূমিতে মানুষের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে এ বন্যার ঝুঁকি নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান এই গবেষক। তিনি বলেন, এসব ভূমিতে যখন নগরায়ন ও কলকারখানা হয়ে যাবে, তখন সেখানে এমনিতেই আলো থাকতে হবে। গেল ১৯ বছরে এসব ভূমিতে কী পরিমাণ নগরায়ন, কলকারখানা ও বসতবাড়ি হয়েছে, তা-ই আমরা দেখেছি গবেষণায়। এভাবে আমরা বন্যার ঝুঁকি নির্ধারণ করেছি।

বন্যার ঝুঁকি কেন বেড়েছে তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, প্লাবনভূমি কমে গেলে বন্যার পানি কোথায় যাবে? তখন তা মানুষের বসতবাড়ি থেকে শুরু করে অবকাঠামোগুলো ডুবিয়ে দেবে। রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

ঢাকা শহরে বন্যার ঝুঁকি অনেক বেশি জানিয়ে আশরাফ দেওয়ান বলেন, ঢাকা শহরের মতো প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা পৃথিবীর কোথাও ছিল না। কিন্তু এরই মধ্যে আমরা ঢাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে মেরে ফেলেছি, ভরাট করে ফেলেছি মহামূল্যবান জলাশয়, পুকুর, খালবিল। যে কারণে শহরটি মারাত্মকভাবে বন্যা কবলিত হওয়ার শঙ্কা আছে।আমাদের বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকতে হবে বলে তিনি মনে করেন। আশরাফ দেওয়ান জানান, ছোট্ট একটা দেশে এতো মানুষ একসঙ্গে থাকে, যে কারণে সুরক্ষামূলক প্রস্তুতি থাকতে হবে ভালোভাবে। এ ছাড়াও সঠিক নীতি গ্রহণ করতে হবে। প্লাবনভূমিগুলোকে রক্ষা করতে হবে।

চলতি শতকের শুরু থেকেই বন্যার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে সেই গতি আরও জোরালো রূপ নিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, আগে প্লাবনভূমিতে বসবাস করতেন ৭ কোটি ২০ লাখের মতো মানুষ। কিন্তু ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি ৭০ লাখের মতো।

‘বাংলাদেশের নদী এলাকায় মানব উপস্থিতি ও বন্যার ঝুঁকির গতিবিধি: বিভিন্ন সময়ের উপগ্রহের ছবির একটি মূল্যায়ন’ শিরোনামের গবেষণাটি জিওকার্টো ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধটির বাকি গবেষকদের একজন বাংলাদেশি আমেরিকান।

গবেষণা অনুসারে, নওগাঁ, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও চট্টগ্রামে বন্যার ঝুঁকি রয়েছে। আর ঢাকা সবচেয়ে বেশি বন্যার ঝুঁকিতে। কারণ রাজধানীর জনসংখ্যার বড় একটি অংশ নদীর পাশে বসবাস করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত সময় সংবাদকে বলেন, আগে পানি যেখানে ওঠার কথা উঠত, এখনো যেখানে ওঠার কথা সেখানে ওঠে। কিন্তু পানি যেখানে ওঠার কথা, এখন সেখানে মানুষ থাকেন। কাজেই মানুষ থাকে বলে তাদের ক্ষতি হচ্ছে। আগে ঢাকার শ্যামলী পর্যন্ত পানি আসতো, কল্যাণপুরে পানি আসতো। এখন মানুষ থাকতে চাইলে পানি আটকাতে হবে। আর পানিকে আটকানো হয়েছে। আর ভিতরে যাতে পানি থাকতে না পারে, সে জন্য পাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বসবাস করতে চাইলে পানি সরিয়ে দিতে হবে। কাজেই পানিকে দোষ দিয়ে কিছু হবে না, পানির কাজ পানি করবেই।

তিনি বলেন, যেসব মানুষ প্লাবনভূমিতে আছেন, তাদের সেখানে থাকতে হলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করতে হবে। কারণ বন্যার পানির সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক আছে। পানি জোর করে আটকে দিলে প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেক্ষেত্রে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।

এদিকে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার আর্থ অবজারভেটরির এক প্রতিবেদন বলছে, ১৯৮৮ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৫৭ লাখ। কিন্তু ২০২২ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ২০ লাখে। জনসংখ্যার এই ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি ঢাকা। যে কারণে এখানকার বহু মানুষকে বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে বাস করতে হচ্ছে।

ঢাকার চারপাশেই নদী। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, পশ্চিমে তুরাগ, উত্তরে টঙ্গীখাল ও পূর্বে বালু নদী। ন্যাচার সাময়িকীর এক বিশ্লেষণ বলছে, ২০০০ সাল থেকে বুড়িগঙ্গা ও বালু নদীর তীরে জনবসতি বেড়েছে।

২০০০ সাল থেকে সিলেটের প্লাবনভূমি ও অববাহিকার ছবিতে আলোর উজ্জ্বলতা ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। অঞ্চলটিতে সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যার ঝুঁকিতে থাকা শীর্ষ ২০ জেলার মধ্যে উত্তরাঞ্চল থেকে রয়েছে নওগাঁ। এ ছাড়া বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়ও বেড়েছে বন্যা শঙ্কা।

About Banglar Probaho

Check Also

আ.লীগ ও সহযোগীদের কাছে লোক চেয়েছে যুবলী

সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আগামীকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় জমায়েতের উদ্যোগ নিয়েছে যুবলীগ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি যখন …

Leave a Reply

Your email address will not be published.