ভারতীয় উপমহাদেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে নিয়ে একটি ভিডিওচিত্র প্রকাশ করেছে বিবিসি। আজ রবিবার তারা এই ভিডিও চিত্র প্রকাশ করে। বেগম রোকেয়ার নানা কর্মকাণ্ড তুলে ধরে ‘বেগম রোকেয়া: দ্য ফরগটেন নাইনটিথ সেঞ্চুরি ফেমিনিস্ট’ শিরোনামের এই ফিচার প্রকাশ করে তারা। ওই ভিডিও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেগম রোকেয়া তার লেখনীতে নারীদের জন্য একটি সুন্দর ও উন্নত বিশ্বের স্বপ্ন আঁকেন।
বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় সমাজ ছিল নানাবিধ কুসংস্কারে পূর্ণ। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে রোকেয়া ছিলেন পঞ্চম। তার বড় ভাইদের মধ্যে ইব্রাহিম সাবের প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাই খলিলুর রহমান সাবের, পরের জন ছিলেন ইসরাইল সাবের। তবে তার সেজ ভাই ইসরাইল সাবের অল্প বয়সেই মারা যান। বোনদের মধ্যে প্রথম ছিলেন করিমুন্নেসা খানম, দ্বিতীয় ছিলেন বেগম রোকেয়া এবং তৃতীয় বোন হোমায়রা খানম। পরিবারে ছিল উর্দু ভাষার প্রচলন। তাদের বাবা মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী না থাকলেও ছেলেদের শিক্ষিত করে তুলতে কোনো কার্পণ্য করেননি। দু’জনকেই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি।
ছোট বেলাতেই রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচবেন। কিন্তু পারিবারিক পরিবেশ অনুকূলে ছিল না। এরপর রোকেয়ার পাশে দাঁড়ান তার বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের। ভাইকে পাশে পেয়ে রোকেয়া লেখাপড়া চালিয়ে যান।
পরে ১৮৯৬ সালে ষোলো বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় খাঁন বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। সাখাওয়াত হোসেন বিপত্নীক ছিলেন। তাঁর আগের পক্ষের একটি কন্যাও ছিল। তাঁদের মধ্যকার বয়সের ফারাকটা এতটাই বেশি ছিল, যাকে একটি শাস্তিমূলক বিষয় হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। সাখাওয়াত হোসেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে দায়িত্বরত ছিলেন তখন। কিন্তু এই বিয়ে যেন আশীর্বাদ হিসেবেই এল রোকেয়ার কাছে। বেগম রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা নিজের অন্তর দিয়েই গ্রহণ করেছিলেন সাখাওয়াত হোসেন। এরই ফল সাহিত্যিক রোকেয়ার আত্মপ্রকাশ।
১৯০৪ সালে রোকেয়ার প্রথম গ্রন্থ ‘মতিচুর’ প্রকাশিত হলো। পরের বছর প্রকাশিত হলো ‘সুলতানার স্বপ্ন’। একটি ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো বিখ্যাত এই লেখাটি। ১৯০৮ সালে তাঁর স্বামী জীবিত থাকাবস্থায়ই এটি বই আকারে বের হয়েছিল। এই বইয়ে রোকেয়া তাঁর কল্পনা শক্তির সাহায্যে এমন এক নারী সমাজের কথা বলেছেন, যেখানে পুরুষ সমাজকে অবরোধ করে রাখা হয়েছে, আর নারীরা বাইরের দুনিয়ায় বিচরণ করছেন এক ঐশী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে। সেখানে কোথাও কোনো পুরুষনির্ভর কাহিনি নেই।
নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, নারীকে মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথাও চিন্তা করেছিলেন তিনি। সাখাওয়াত হোসেন এই জন্য বেগম রোকেয়াকে দশ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বল্পকালীন বিবাহিত জীবনে সেই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারলেন না রোকেয়া। স্বল্পায়ু নিয়ে জন্ম নেওয়া তাঁর দুই মেয়ে মাস কয়েকের ব্যবধানে মারা গেলে তিনি প্রচণ্ড মানসিক কষ্টের মধ্যে পড়ে যান। এই অবস্থায় সাখাওয়াত হোসেনও মারা গেলেন ১৯০৯ সালের ৩ মে।
স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাস পর ভাগলপুরে শুরু করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। কিন্তু এই অবস্থায় সাখাওয়াতের আগের ঘরের মেয়ে ও তার জামাতার বিরুদ্ধাচরণ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাল যে, তিনি তাঁর সব কাজ পরিহার করে চলে এলেন কলকাতায়। ১৯১১ সালে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে নতুনভাবে শুরু করলেন স্কুল। এই স্কুলটি ছিল ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানকারী প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়। এই আটজন ছাত্রীর যাতায়াতের জন্য কলকাতার একজন ব্যবসায়ী প্রথম একটি ঘোড়ার গাড়ি উপহার দিলেন। এদিকে সাখাওয়াত হোসেন যে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন, ‘বার্মা ব্যাংক’ নামক একটি ব্যাংকে তা জমা রাখা হয়েছিল। ব্যাংকটি দেউলিয়া হলে পুরো টাকাই নাই হয়ে গেল। চরম বিপদে পড়লেন রোকেয়া। এই অবস্থায় কিছু দানশীল ব্যক্তির সাহায্য এবং পরিচালনা কমিটির সদস্যদের মাসিক চাঁদার ওপর নির্ভর করে স্কুলটি চালিয়ে গেলেন। ১৯১৫ সালে ছাত্রীসংখ্যা ৪০-এ উন্নীত হলে স্কুলটিতে পঞ্চম শ্রেণি চালু করলেন এবং একে একটি উচ্চবিদ্যালয়ে উন্নীত করলেন। ১৯৩১ সালে ওই স্কুল থেকে তিনজন ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণও হলো।
রোকেয়া একজন উঁচু মানের সমাজসংস্কারকও ছিলেন। ১৯১৭ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে বিখ্যাত আলী ভাইদের মা বি আম্মা বেগম ও অ্যানি বেশানতের আগমন উপলক্ষে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে বেগম রোকেয়া তাঁর কয়েকজন অনুগামী নিয়ে যোগ দেন। এ ছাড়া ১৯১৬ সালে কলকাতায় আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ১৯১৭ সালে ওই সংগঠনের ৫০ জন মহিলা সদস্যের উপস্থিতিতে ১৫ এপ্রিল প্রথম বার্ষিক সম্মেলন করে একটা যুগান্তকারী ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন। এ ছাড়া নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
১৯৩০ সালের দুই ডিসেম্বর প্রথম মুসলিম মহিলা হিসেবে উড়োজাহাজে চড়ে আকাশভ্রমণের সুযোগও গ্রহণ করেছিলেন রোকেয়া। তাঁর এ-সংক্রান্ত লেখা ‘বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল’ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। রোকেয়ার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। মাত্র পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে ‘পদ্মরাগ’, ‘মতিচুর’ (দুই খণ্ড), ‘অবরোধবাসিনী’ ও ‘সুলতানার স্বপ্ন’। মৃত্যুর পর বিভিন্নজনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপের একটি সংকলন বের হয়েছিল। সেখানে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘যদি কিছু টাকা পেতাম, বড় শখ ছিল একটা মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার।’ সেই স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পাননি তিনি।
মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা গেলেন মহীয়সী এই নারী। যে রাতে মারা গেলেন, ওই রাতেও লেখালেখি করেছেন। মৃত্যুর পর তাঁর টেবিলে পেপারওয়েটের নিচে ‘নারীর অধিকার’ শীর্ষক একটি অর্ধসমাপ্ত লেখা পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর নিশ্বাস, বিশ্বাস, কর্ম ও ধ্যানে শেষ পর্যন্ত তিনি সেই একই চিন্তাধারাকে লালন করে গেছেন—‘মেয়েমানুষ নয়, মানুষ হয়ে বাঁচতে হবে, তবেই সার্থক মানবজনমের।’