সৌদি আরব এবং রাশিয়ার নেতৃত্বে ওপেক ও অন্য তেল উৎপাদনকারীরা (সংক্ষেপে ‘ওপেক প্লাস’) এ মাসের শুরুতে দিনে ২০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ববাজারকে হকচকিয়ে দিয়েছে। হ্রাসকৃত এই পরিমাণ বিশ্বব্যাপী সরবরাহের প্রায় ২ শতাংশের সমান।
সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে অপরিশোধিত তেলের (ব্রেন্ট ক্রুড) দাম ব্যারেলপ্রতি এক শ ডলারের ঊর্ধ্বে উঠিয়ে দেওয়া এই সিদ্ধান্ত তেলের দাম বাড়াতে উৎপাদনকারী গোষ্ঠীর (যাদের সংবাদমাধ্যমে সাধারণত ‘কার্টেল’ নামে উল্লেখ করা হয়ে থাকে) সংকল্পের ইঙ্গিত দেয়। এই সিদ্ধান্ত আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।
তবে এটি সৌদিকে ফের বাজারদর নিয়ন্ত্রকের (সুইং প্রডিউসার) ভূমিকায় আসার ক্রমবর্ধমান ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করেছে; একই সঙ্গে তা রাশিয়ার সঙ্গে সৌদির নতুন গাঁটছড়া বাঁধার বিষয়টিকে সামনে আনছে।
বৈশ্বিক তেল উৎপাদন সংকুচিত হওয়া এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর সৃষ্ট বৈশ্বিক পরিস্থিতি ওপেক প্লাসের সংহতিকে প্রয়োজনীয় করে তুলেছে এবং এর সদস্যদের যৌথ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাকে আরও কার্যকরভাবে সমন্বয় করতে উদ্বুদ্ধ করছে। কিন্তু শুধু সমন্বয় বিশ্বব্যাপী মূল্য নির্ধারণকারী হিসেবে কার্টেলের ভূমিকা সংরক্ষণ করতে পারবে না। এই ভূমিকা নির্ভর করছে বাজারের সুইং প্রডিউসার হিসেবে নিজের ঐতিহ্যগত কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার বিষয়ে সৌদি সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর।
ওপেক প্লাসের এ সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্কের ওপর যখন অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টির হুমকি দিচ্ছে, তখন তেল উৎপাদনের লক্ষ্যটি কার্যত অলীক বিষয় হয়ে পড়ছে। নতুন চুক্তি অনুযায়ী, কার্টেল নভেম্বর থেকে দৈনিক ৪ কোটি ২০ লাখ ব্যারেল উৎপাদন করবে বলে ঠিক করলেও ইতিমধ্যে তারা দৈনিক উৎপাদন ৩ কোটি ৯০ লাখ ব্যারেলে নামিয়ে এনেছে। তারা অক্টোবরে যা উৎপাদন করবে বলে ঠিক করেছিল, বাস্তবে সেই উৎপাদন হয়েছে তা থেকে ৪৫ লাখ ব্যারেল কম; কারণ উৎপাদনকারী গ্রুপের ২৩ সদস্যের মধ্যে ১৫ সদস্যেরই নিজ নিজ কোটা পূরণ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সৌদি আরবের সুইং প্রডিউসার হিসেবে কাজ করার ইচ্ছা নির্জলা স্বার্থ দ্বারা তাড়িত। তাদের সাম্প্রতিক উৎপাদন কমানোর লক্ষ্য হলো তেলের দাম বাড়িয়ে গড়ে ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলারে নিয়ে যাওয়া। এটি রাশিয়ার তেলের দাম সীমাবদ্ধ করার মার্কিন প্রচেষ্টাকেও দুর্বল করে দেবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই সৌদির ওপর খেপেছে।
ওপেক প্লাস সম্ভবত নভেম্বরে প্রতিদিন ১০ লাখ ব্যারেল উৎপাদন কমিয়ে দেবে। যে সদস্যদেশগুলো লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে, তারা সম্ভবত উৎপাদন কমাবে না। উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করতে ওপেক প্লাসভুক্ত মাত্র আটটি দেশকে তেলের উৎপাদন কমাতে হবে।
সৌদি আরব প্রতিদিন ৫ লাখ ব্যারেল উৎপাদন কমিয়ে হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রার বেশির ভাগ বোঝা বহন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০–এর দশকে সৌদি আরব ছিল প্রতারণা এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত একটি কার্টেলের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময় দেশটি উচ্চ মূল্য ধরে রাখার জন্য নিজস্ব উৎপাদন সামঞ্জস্য করে সুইং প্রডিউসারের ভূমিকা পালন করতে অস্বীকার করে।
মার্কিন শেল-এনার্জি বিপ্লবের পর ওপেকের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস পেলে সৌদিরা আশঙ্কা করেছিল, আমেরিকান উৎপাদকেরা তেলের উচ্চমূল্য থেকে উপকৃত হবে এবং সৌদি সরকারের খরচে তাদের বাজারের অংশীদারি প্রসারিত করবে। ফলস্বরূপ, সৌদি উৎপাদন বাড়িয়ে দেয় এবং তেলের দাম ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের প্রথম দিকে প্রায় ব্যারেলপ্রতি ১১০ ডলার থেকে ২৯ ডলারে নেমে আসে।
এর ফলে ওপেকের প্রতিটি সদস্য আরও খারাপ অবস্থায় পড়ে। ঐতিহ্যবাহী তেল উৎপাদকদের আর্থিক অবনতি হওয়ায় সৌদি আরবকে তাদের চিরশত্রু ইরানের দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়ার সঙ্গে অস্বস্তিকর জোটে বাধ্যতামূলকভাবে আবদ্ধ হতে হয়।
সৌদি ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন বর্ধিত কার্টেল মার্কিন শেল প্রডিউসারদের অতি মুনাফালাভকে আঘাত করলেও তাদের বাজার থেকে তাড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। রাশিয়ান এবং সৌদিরা একটি সাধারণ ফ্রন্ট গঠন করতে এবং একটি যৌথ উৎপাদন কৌশলে সম্মত হতে চেষ্টা করেছিল, যার ফলে একটি অভূতপূর্ব মূল্যযুদ্ধের সূচনা হয়, যা ২০২০ সালের বসন্তে ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (আমেরিকাভিত্তিক অপরিশোধিত তেল)-এর দরকে তলানিতে নিয়ে যায়।
নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সৌদি আরবের সুইং প্রডিউসার হিসেবে কাজ করার ইচ্ছা নির্জলা স্বার্থ দ্বারা তাড়িত। তাদের সাম্প্রতিক উৎপাদন কমানোর লক্ষ্য হলো তেলের দাম বাড়িয়ে গড়ে ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলারে নিয়ে যাওয়া। এটি রাশিয়ার তেলের দাম সীমাবদ্ধ করার মার্কিন প্রচেষ্টাকেও দুর্বল করে দেবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই সৌদির ওপর খেপেছে।